
ঈদের ছুটিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যায়, তখন নীরবতা যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হলের অধিকাংশ রুমগুলো তালাবদ্ধ, ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ, হাঁটাহাঁটির চেনা কোলাহল থেমে যায়। এমন এক নিস্তব্ধ পরিবেশে এবার ঈদের পুরোটা সময় কাটাচ্ছেন নেপাল থেকে আসা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী দীপেশ আরিয়াল।
"এবার বাড়ি যাইনি। পূজার সময় পরিবারে যাব, সেই পরিকল্পনাই আছে,"– ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বললেও খুব সুন্দর ও স্পষ্ট বাংলা বলতে পারেন দীপেশ।
শান্ত ক্যাম্পাস, মিশ্র অনুভূতি:
ছুটির সময় সবাই যখন বাড়ির পথে রওনা দেয়, তখন দীপেশ থেকে যান ফাঁকা চার দেয়ালে। "ক্যাম্পাস ফাঁকা হলে মনটা খারাপ হয়ে যায় ঠিকই,"– বলেন তিনি, "কিন্তু অন্যদিকে, রাতের ক্যাম্পাসে সাইকেল চালানো, একা একা ঘোরাঘুরি – এগুলোরও এক আলাদা শান্তি আছে।"
দেশ থেকে দূরে উৎসবের সময়:
নেপাল থেকে আসা এই শিক্ষার্থী বলছেন, "শুরুতে নিজের দেশ ও সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা খুব কঠিন ছিল। মনে হতো যেন পরিচিত সবকিছু পেছনে রেখে অচেনা একটা পৃথিবীতে এসে পড়েছি। এখন অবশ্য অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি।"
তবু বিশেষ করে উৎসবের সময়গুলো তাকে নাড়া দেয়।
"সবাই যখন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়, তখন নিজের পরিবারের কথা খুব মনে পড়ে। সেই চেনা উঠোন, সকালবেলা পাখির ডাক, দাদুবাড়ি যাওয়া, মামার বাসায় খাওয়া-দাওয়া—সব মিস করি। তখন একা একা মন খারাপ হয়।"
ঈদুল আযহা বনাম দশাইন:
দীপেশ বলেন, “তোমাদের যেমন সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ, আমাদের নেপালে সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ‘দশাইন’, যেটা বাংলাদেশে ‘দশমী’ নামে পরিচিত। এই সময় আমরা সবাই মিলে দাদু-নানুর বাড়ি যাই, টিকা লাগানো হয়, খাসি কাটা হয়, মিলেমিশে উৎসব করি। এই মুহূর্তগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি, উৎসবের দিনগুলোতে আমি এগুলো খুবই মিস করি।”
ঈদের যে দিকটি সবচেয়ে ভালো লাগে দীপেশের:
“এই উৎসবে যখন গরু কাটা হয়, তখন মাংস তিন ভাগে ভাগ করে – এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ গরীবদের জন্য আরেক ভাগ প্রতিবেশীদের জন্য। আমি এটা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। যারা গরীব, তারাও যেন ঈদের আনন্দ থেকে বাদ না পড়ে – এটা সত্যিই খুব পছন্দের।” হাসি মুখে বললেন দীপেশ।
ছুটির চ্যালেঞ্জ ও অভ্যাসের বদল:
প্রথম প্রথম ছুটিতে একা ক্যাম্পাসে থাকা বেশ কষ্টদায়ক ছিল দীপেশের জন্য। বিশেষ করে খাবার নিয়ে ছিল নানা সমস্যা। “হোটেলগুলো বন্ধ থাকে, খাওয়ার ব্যবস্থা করা খুব কঠিন হয়ে যায়। তখন বুঝেছি পরিবার ছাড়া উৎসব কেমন কঠিন হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
তবে সময়ের সঙ্গে অভ্যাস হয়েছে। এখন আর খুব একটা অসুবিধা হয় না। বরং একা থাকার মধ্যেও নিজের মতো করে সময় কাটানোর অভ্যেস তৈরি হয়েছে তার।
এমন লম্বা ছুটি কিভাবে কাটাতে হবে, এ নিয়ে দেশের বাইরে থেকে পড়তে আসা নবীনদের প্রতি পরামর্শের স্বরে দীপেশ বলেন: "যদি বড় ছুটি পাও, বাড়ি চলে যাও। পরিবারে ফিরে যাওয়ার মতো শান্তি আর কিছু নেই। যতই স্বাধীনতা থাকুক, পরিবারের সান্নিধ্যই জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।"
বিদেশে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য উৎসব এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দীপেশ সেই গল্পের প্রতিনিধি, যার এবারের ঈদুল আযহার কাটি কাটছে দূরত্বে থাকা পরিবারের স্মৃতিতে। এক সময় যেটা ছিল কষ্ট, এখন সেটাই হয়ে উঠেছে মানিয়ে নেওয়ার শক্তি। ভিনদেশে থেকেও সংস্কৃতির মাধুর্য অনুভব করা যায়—এই উপলব্ধিই দীপেশের শক্তি।
আঁখি