ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

খাগড়াছড়িতে গাছ হত্যার অভিনব কৌশল: ছাল তুলে ধ্বংস!

জীতেন বড়য়া, খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ২৭ মে ২০২৫

খাগড়াছড়িতে গাছ হত্যার অভিনব কৌশল: ছাল তুলে ধ্বংস!

ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ।

ছেঁটে দেওয়া হয়েছে গাছের ডালপালা। এখানেই শেষ নয়, গাছের কান্ড থেকে গোল করে তুলে ফেলা হয়েছে বাকল। এর ফলে কোন কোন গাছ এক সপ্তাহের মধ্যে মরে যেতে শুরু করেছে আবার কোনটা দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। ১টি বা ২টি নয়, এভাবে প্রায় ১০০ টির বেশি গাছকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর মুখে। গাছ হত্যার এমন নিষ্ঠুর কৌশল দেখা গেছে খাগড়াছড়ির জেলার পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়ক, খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়ক এবং দীঘিনালা- বাবুছড়া সড়কে।

ছায়া সুনিবিড় এই পাহাড়ি সড়কের দুই ধারে রয়েছে রেইনট্রি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ নানা প্রজাতির প্রায় হাজার খানেক গাছ। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে মাঝে মাঝে এই তিন সড়কের গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা হয় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের নিরাপত্তার স্বার্থে। তবে অনেক সময় ডালপালা ছাঁটার পাশাপাশি অনেক গাছের বাকলও তুলে ফেলা হয়েছে। 
সড়কের পাশে বসবাস করা স্থানীয় লোকজন বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়োজিত শ্রমিকেরাই অধিকাংশ গাছের ডালপালা ছাঁটার সময় বাকল তুলে ফেলেছেন। তবে স্থানীয়রাও অনেক সময় রোদ লাগার জন্য বাকল তুলেন তবে এটা তুলনামূলক ভাবে কম। 

তবে বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ডালপালা ছাঁটার বিষয়টা স্বীকার করলেও বাকল তুলে ফেলার বিষয়টি জানেন না বলে স্বীকার করেন। এমন নির্দেশনাও কর্মীদের দেননি বলে জানান। এ নিয়ে সড়ক বিভাগ খাগড়াছড়ি সদর থানায় একটি সাধারন ডায়েরি (জিডি) করেছেন বলে জানান। 

সড়কের দুই পাশে ছাতার মতো ঢেকে রেখেছিলো দুই পাশের গাছ গুলো। সড়ক বিভাগের মালিকানায় থাকা গাছগুলোর বেশির ভাগই লাগিয়েছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসী ও  সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। গাছ হত্যার এমন অপকৌশলে তাঁরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। প্রায় ২৫-৩০ বছর বয়সী এসব গাছ সড়কগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়েছিল। এখন অনেক স্থানে গাছ মরে গেছে, অনেকস্থানে মরে যেতে শুরু করেছে। কারও উপর যাতে ভেঙে না পড়ে, সে কারণে কিছু মরা গাছ কেটে ফেলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে এখন সড়ক গুলোর চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। ছায়া সুশীতল সড়ক গুলো হয়ে পড়বে বৃক্ষহীন, এটা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। 

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক ও জনপদ বিভাগের কর্মকর্তারাও। খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের  নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুুদুর রহমান বলেন, সড়কের দুই পাশের গাছ সড়ক বিভাগের। কিন্তু ডাল কাটার সময় বিদ্যুৎ বিভাগ কখনো সড়ক বিভাগকে জানায় না। এক বছর আগেও ছাল উঠিয়ে গাছ মারার কারণ জানতে ছেড়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আবারো গাছের ছাল উঠানো হচ্ছে বিষয়টি শুনেছি। সড়ক বিভাগ থেকে সরেজমিন দেখে এসে আবারও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের ঠাকুরছড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ৮টি গাছের বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এরমধ্যে ৫টি গাছ কেটে নিয়েছে এলাকার লোকজন। বর্তমান মরে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে আর ৩টি গাছ। আবার পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের কুকিছড়া এলাকায় ১১টি, শিবমন্দির এলাকায় ৯টি, গাছবান এলাকায় ৫টি, ছোটনালা এলাকায় ৩টি, গিরিফুল এলাকায় ৬টি, মঞ্জু আদাম এলাকায় ৮ টি, কুড়াদিয় এলাকায় ৭ টিসহ শুধুমাত্র এই সড়কে ৪০-৫০ টির বেশি গাছের বাকল ও নিচের অংশ তুলে ফেলা হয়েছে। এছাড়া দীঘিনালা খাগড়াছড়ি সড়কের শান্তিপুর এলাকায় ৮টা, ব্রিকফিল্ড এলাকায় ৪ টা, বানছড়া ৪, কার্বারীটিলা ১টা গাছের বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক গাছ মরে গেছে আর কিছু গাছ শুকিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এই সড়ক গুলোতে এভাবে গাছ হত্যা করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সড়কের দুই পাশে আর কোন গাছের অস্ত্বিত্ব থাকবে না।

পানছড়ি খাগড়াছড়ি সড়কের যাতায়াত করা লোকজন এবং গাড়ির চালকেরা জানান, পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের দুই পাশ জুড়ে একসময় ২০ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো শত শত গাছ ছিলো। গাড়িতে আসা-যাওয়ার সময় পুরো সড়কে ছায়া থাকতো। চার থেকে পাঁচ বছর ধরে ছাল তুলে গাছ গুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে।
 
ঠাকুরছড়া এলাকার বাসিন্দা দিনেশ কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘গত বর্ষার সময় গাছের ঢাল কাটতে প্রায় ২৫-৩০ বছরের পুরোনো তিনটি রেইনট্রি গাছের নিচের অংশের ছাল এবং গাছ চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি পুরু করে তুলে দেয়। ছাল উঠানোর কারনে গাছের মরা ডাল রাস্তার উপর পড়তে থাকে। যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’  
 
গাছবান এলাকা সড়কের পাশে বাসিন্দা রবিন চাকমা। তার বাড়ির পাশে রয়েছে অনেক গাছ। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন প্রতি বর্ষায় বাঁধা দেওয়ার পরও গাছের ঢাল ছাঁটাই করতে এসে গাছের ছাল তুলে দেয়। এতে গাছ গুলো ধীরে ধীরে মরে যায়। মরা ঢাল গুলো সামান্য বাতাস আসলে ভেঙ্গে পড়ে। যে কোন মুহুর্তে সড়কের উপর ঢাল পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’  
 
দীঘিনালা - বাবুছড়া সড়কে শান্তিপুর এলাকার মিতালী চাকমাও বলেন, ‘সড়কের পাশে একসময় অনেক গাছ ছিলো। ছোট বেলায় স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় দলবেঁধে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতাম। এই কয়েক বছর হলো দেখতেছি গাছের ছাল তুলে দেওয়া হচ্ছে। ছাল তুলে দেওয়ায় পর এক বছরের মধ্যে গাছ মরে যায় আর কিছু গাছ অর্ধেক মরা অবস্থায় থাকে।’

সড়কের পাশের গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়ে বেলা নেটওয়ার্কের সদস্য আবু দাউদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন কোন ভাবে এই কাজ করতে পারেন না। যেখানে লোকজন গাছ লাগাচ্ছে সেখানে সরকারি বিভাগের লোকজন হয়েও কিভাবে অভিনব পদ্ধতিতে গাছ মেরে ফেলছেন তারা। তাদের আইনত দণ্ড হওয়া উচিত।’  

খাগড়াছড়ি বিদ্যুৎ বিতরণ ও সম্প্রসারণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়জুল আলীম আলো বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগ দূর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুতের তাঁরের সাথে লাগোয়া গাছের ঢাল কাটে প্রতি বছর। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনই সাধারনত শ্রমিক দিয়ে এসব গাছের ঢাল কেটে থাকে। তবে এ বছর এখনো কোন লাইনে ঢাল কাটা হয় নাই। তবুও আমাদের কোন কর্মচারী কিংবা কর্মকর্তা যদি গাছের ঢাল কাটার সময় ছাল তুলে ফেলছে এমন অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া যে শ্রমিকরা গাছের ঢাল কাটে তাদের বাদ দেওয়া হবে। আগামিতে গাছের ঢাল কাটার আগে সড়ক বিভাগের সাথে সমন্বয় করা হবে।’

মিরাজ খান

×