
ছবি : জনকণ্ঠ
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা চা আর প্রকৃতির সৌন্দর্যে সবার নজর কাড়লেও এখন সেখানে ক্ষত হিসেবে দেখা দিয়েছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন। প্রায় ৫ বছর বন্ধ থাকার পর আবারও শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর তোলার মহোৎসব। পাথরমহাল ইজারার কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল। পতিত ও ফসলি জমি এবং নদীর বুক চিরে দৈনিক কয়েকশো ড্রেজার মেশিন দিয়ে তোলা হচ্ছে পাথর। শুধু দিনে নয়, রাতভর চলছে ড্রেজার মিশন। একটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় তোলা হচ্ছে অন্তত ১০ টলি পাথর। প্রশাসন অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেও ড্রেজার চক্রের সাথে পেরে উঠতে পারছে না। পথের মোড়ে মোড়ে থাকে তাদের সোর্স। অভিযানে বের হওয়া মাত্রই খবর পেয়ে যায় তারা। তবে এবার কোনো ব্যক্তি নয়, পাথর উত্তোলনের এই যজ্ঞে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পঞ্চগড় পাথর-বালি যৌথ ফেডারেশনের নেতারা। দৈনিক তাদের সাইটপ্রতি ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে দাবি করেন মেশিন মালিকরা। দেড়শ থেকে দুইশ সাইট থেকে পাওয়া বিরাট অঙ্কের টাকা রোজ ভাগবাটোয়ারা হয় বলেও জানান তারা। এই টাকা রাতারাতি পৌঁছে যায় প্রভাবশালী সব মহলে। এভাবেই ড্রেজার দিয়ে পাথর তুলে রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠছেন একটি শ্রেণি। আর অন্যদিকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে পাথর কোয়ারিগুলোর ইজারার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নোটিশ প্রকাশিত হলে এর অপব্যাখ্যা দিয়ে শুরু হয় পাথর উত্তোলন। জেলা প্রশাসন ইজারার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই বেপরোয়া হয়ে উঠে তেঁতুলিয়া উপজেলার একটি শ্রেণির মানুষ। শুরু হয় পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। নির্বিচারে ব্যবহার শুরু হয় ড্রেজার মেশিনের। পাথর উত্তোলনের জন্য বেছে নেওয়া হয় বেশিরভাগ নদীর দুর্গম এলাকাকে। করতোয়া, সাঁও, ডাহুক, তালমা, চাওয়াইসহ নদীর বুকে এখন ড্রেজারের ক্ষত। এছাড়া সমতলের কিছু পতিত জমি ও ফসলি জমি থেকেও একই কায়দায় তোলা হচ্ছে পাথর।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর, গনাগছ, ভদ্রেশ্বর, ভূতিপুকুর, ক্ষণিয়াগছ, শুকানি, নিজবাড়ি, কালিতলা, শালবাহান, কীর্তনপাড়া, ময়নাগুড়ি, জয়গুণজোত, প্রধানগছ, পাঠানপাড়া, পাথরঘাটা, দেবনগর, বড়বিল্লাহসহ বিভিন্ন এলাকায়, পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বেঙ্গুপাড়া, হাজিরঘাট, মধুপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, খালপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তোলা হচ্ছে পাথর।
বেশিরভাগ পাথরের সাইটে পানি তোলা ও বালুকাটার নাম করে যে মেশিন (শ্যালো) ব্যবহার করা হচ্ছে তা দিয়েই তোলা হচ্ছে পাথর। নিচে ব্যবহার করা হয় জিকজ্যাক পাইপ আর খুলে দেওয়া হয় চেকবল—আর উঠতে থাকে পাথর। ড্রেজার বেশি ব্যবহার করা হয় রাতের আঁধারে।
এরই মধ্যে পাথর উত্তোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। পথে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে সোর্স। প্রশাসন অভিযানে বের হওয়া মাত্রই খবর পেয়ে যাচ্ছে তারা। তাই দুর্গম এলাকা হওয়ায় ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সরিয়ে ফেলা হয় মেশিন। অনেক সময় শ্রমিক ও ড্রেজার মালিকদের তোপের মুখে পড়তে হয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমকর্মীদেরও। ছবি তুলতে বাধা দেওয়া হয়। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেও শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের সাথে পেরে উঠতে পারছে না প্রশাসন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম যখন এলাকায় থাকে তখন বন্ধ করে দেওয়া হয় সব মেশিন। তারা সরে গেলেই আবার পুরো দমে চালু করা হয়।
পাথর উত্তোলনকারীরা জানান, জেলার ১৯টি পাথরমহালের মধ্যে ১৬টি ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন। সবগুলোই নানা ব্যক্তির নামে নিয়েছে জেলা পাথর-বালি যৌথ ফেডারেশন। নেতৃত্বে রয়েছেন তেঁতুলিয়া উপজেলা পাথর-বালি সরবরাহকারী সমিতির সভাপতি ও পাথর-বালি যৌথ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক যুবদল নেতা হামিদুল হাসান লাবু এবং তেঁতুলিয়া উপজেলা পাথর-বালি ব্যবসায়ী ও শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল। অভিযোগ রয়েছে, তাদের নেতৃত্বেই চলছে অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাথর উত্তোলন। কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই তারা প্রতিটি গাড়ি থেকে তুলছেন টাকা। এছাড়া প্রতিটি পাথরের সাইট থেকে দৈনিক ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন। বিরাট অঙ্কের এই টাকা রোজ ভাগবাটোয়ারা হয় বলে জানান তারা। এই টাকা দিয়েই সব মহলকে ম্যানেজ করা হয়।
এছাড়া ১৬টি পাথরমহালের নির্ধারিত স্থান চিহ্নিত করা থাকলেও মানছে না কেউ। বেশিরভাগ পাথরের সাইট করা হয়েছে মহালের বাইরেই।
এভাবে দৈনিক শতাধিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করায় চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। তারা জানান, এর আগেও তেঁতুলিয়াসহ পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে হাজার হাজার গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। আবারও ১০০ থেকে দেড়শ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হচ্ছে অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাথর উত্তোলনের কারণে। তাই হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এ জনপদে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ব্যাপক ভূমিধ্বসের আশঙ্কা করছেন তারা। একই সঙ্গে নদীর বুকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে হুমকিতে পড়ছে নদীজীববৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমিও।
পাথর শ্রমিক আজিজার রহমান বলেন, আমাদের এলাকায় অন্য কোনো কাজের সুযোগ নেই। পাথরের কাজ করেই আমাদের সংসার চলে। ড্রেজার চললে আমাদের সমস্যা। কারণ ২০ থেকে ৩০ জন শ্রমিক যে কাজ করে তা একাই ড্রেজার দিয়ে করা যায়। আমরা চাই সনাতন পদ্ধতিতে যেন পাথর তোলা চালু থাকে।
পাথর উত্তোলনকারী শাহ আলম বলেন, আমরা জমি লিজ নিয়ে পাথর উত্তোলন করছি। প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয় ফেডারেশনকে। শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয়। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, সেই টাকাই তুলতে পারিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করতে গেলে মেশিন ব্যবহার করতেই হবে। যেসব মেশিন দিয়ে বালি কাটা হয়, সে মেশিনের চেকবল সরিয়ে দিলেই পাথর উঠে। ঠিকমতো ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পাথর উত্তোলন করা গেলে অন্তত ১০ টলি পাথর ওঠে। যার বাজার মূল্য প্রায় লাখ টাকা। তাই ঝুঁকি নিয়েই পাথর তোলে সবাই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পঞ্চগড়ের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম আনোয়ারুল খায়ের বলেন, পাথরমহলের ইজারার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিজ্ঞপ্তিটি পাওয়ার পর অপব্যাখ্যা দিয়ে পাথর তোলা শুরু হয়। নির্বিচারে ড্রেজার মেশিন দিয়ে দিনে-রাতে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রভাবশালী একটি মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এভাবে নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে। এলাকা ও পরিবেশের জন্য তারা কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে তা বুঝতে পারছে না। আমরা অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাথর উত্তোলন বন্ধের জন্য প্রশাসন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি।
পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু বলেন, যারা এসব বিষয়ে আওয়াজ তোলার কথা, দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকেই এই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। ড্রেজার মেশিনের ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে আগামীতে কঠিন মূল্য দিতে হবে এ জনপদের মানুষকে। পঞ্চগড় দেশের দ্বিতীয় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে নবগঠিত এ মাটি ধসে যাবে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা পাথর-বালি ব্যবসায়ী ও শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা নিজেরাই ড্রেজার মেশিন চালানোর বিপক্ষে। তবে যেসব মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে তা দিয়ে কেবল বালি কাটা ও পানি তোলা হয়। ৩৫ হর্স পাওয়ারের বেশি মেশিন ড্রেজার মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে যেসব মেশিন চলে তা তার কম হর্স পাওয়ারের। আমাদের সংগঠনের ২২০০ সদস্য রয়েছে। সবার কাছ থেকেই ইজারার টাকা নেওয়া হয়েছে। কেউ বেশি, কেউ কম—এভাবে টাকা তুলেই পাথরমহালগুলি ইজারা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমরা ৫১ লাখ টাকা জমা দিয়েছি। প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়ে পাথর-বালি মহাল নিয়ে আমাদের ৫/৭ হাজার টাকায় কি পেট ভরবে, না কি রয়্যালটি কালেকশন করতে হবে?
কার্যাদেশের আগেই পাথর উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। মানুষজন বাধা-নিষেধ মানছে না। তবে কিছু মানুষ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, এখনো পাথরমহালগুলির কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। যারা অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাথর-বালি উত্তোলন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। পুলিশ ও বিজিবির সহযোগিতায় অভিযানে এর মধ্যে কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একাধিক মামলাও হয়েছে। মানুষের কর্মসংস্থান যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টিও আমাদের চিন্তা করতে হবে। তাই কখনোই অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাথর-বালি উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না।
সা/ই