
পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার শিতলাই গ্রামে অবস্থিত ইন্দো-ইউরোপিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র’র ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। যা অনেকের কাছে "শিতলাই হাউজ" নামেও পরিচিত। শীতলাই গ্রামে অবস্থিত মৈত্র জমিদার বংশের শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে দাড়িয়ে থাকা বাড়িটি কালের বিবর্তনে বিলীন হওয়ার পথে। বাড়িটির দেয়ালের ইট, চুন সুড়কি খসে পরছে। ধারণ করেছে বুকে অসংখ্য ফাঁটল। এখনো বাড়িটি তার প্রাচীনত্ব ও আভিজাত্যের ছাপ বহন করছে। ভগ্নদশায় নিপতিত বাড়িটির দেওয়াল, ছাদ সর্বত্রই ভরে আছে আগাছায়। এখন ভুতের ভিটা হিসেবে রূপ নিয়েছে। শীতলাইয়ের মৈত্র জমিদার বংশের শেষ স্মৃতি চিহ্ন টুকু বিলুপ্ত হচ্ছে।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, পাঠান শাসনামলে চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল গ্রাম থেকে দুই মাইল দক্ষিণে ও সমাজ গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে শীতল খাঁ নামক এক ব্যক্তি গ্রামটির পত্তনী করেন। কালক্রমে তার নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয়ে যায় শীতলাই। পরে সে গ্রামেই স্থাপিত হয় জমিদার বাড়ি যা শীতলাই জমিদার বাড়ি নামে সমধিক পরিচিত। লোকনাথ মৈত্র এ জমিদারীটি কিনলেও পরবর্তীতে যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র শীতলাই গ্রামে বাসস্থান তৈরী করে এ গ্রামে বসবাস শুরু করেন।
শীতলাই জমিদার বংশের গোড়া পত্তন করেন জমিদার চন্ডী প্রসাদ মৈত্র। চন্ডী প্রসাদ মৈত্রের ছেলে জগন্নাথ মৈত্র এ বংশের দ্বিতীয় জমিদার। জগন্নাথ মৈত্রের ছেলে লোকনাথ মৈত্র রাজশাহীতে মোকতারী করতেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রেয় প্রায় ১৯০০ শতকের প্রথম দিকে এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। তবে এই জমিদার বংশের মূল হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয় তিনি জমিদার চাঁদীপ্রসাদ মৈত্রেয়। তারই বংশ পরিক্রমায় যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রেয় তার জমিদারী বংশের পূর্ববর্তী জমিদারী এলাকা সিরাজগঞ্জ জেলার শরৎনগর ছেড়ে পাবনা জেলার শিতলাই নামক এলাকার জমিদারী স্থানান্তর করেন। এই জমিদার বাড়িটি তারই নির্মাণ করা। বিশালাকার জমিদার বাড়িটি এখন ভগ্নাবশেষটুকু অবশিষ্ট আছে। একসময় যে মন্দিরে আলো ঝলমল করতো, পাইক পেয়াদার হাক-ডাক ছিল, এই মন্দির ঘিরে উৎসব হতো, বর্তমানে সেখানে সুনসান নিরবতা। আরও অনেক জমিদার বাড়ির মতোই এর অবস্থাও জরাজীর্ণ।
এই বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় দুইশ বছরের ইতিহাস। জমিদার বাড়িটি ইন্দো-ইউরোপীয়ান স্থাপত্যশৈলিতে নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকটি এক তলা ইটের ঘর ও এটি দুই তলা বিশিষ্ট বাড়ি। বাড়িটিতে ৩০টি কক্ষ রয়েছে। জমিদার বাড়ির পাশে রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি বিশালাকার আয়তনের দীঘি। যার চতুর দিকে শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পুকুরের টলটলে জল সবাইকে মুগ্ধ করবেই। যার পাশে দাড়ালে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়।
শীতলাই মৈত্র জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা লোকনাথ মৈত্র রাজশাহীতে মোক্তারী করতেন। সেই সময় তার দানে রাজশাহীতে লোকনাথ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। লোকনাথ মৈত্র মহাশয় কয়েকটি জমিদারী (লাটবন্দী) ক্রয় করেন। তাঁর একমাত্র কন্যা রাজরাজেশ্বরী দেবীর বিবাহের কয়েকদিন পরই মৃত্যু হওয়ায় তিনি অত্যন্ত আঘাত পান। কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে কাশীধামে রাজরাজেশ্বরী নামে একটি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
লোকনাথ মৈত্র অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করলে তার স্ত্রী সোনামণী দেবী নাটোর মহকুমার বলদখান গ্রামের চন্দ্রনাথ নামক এক গরীব সন্তান পোষ্য নেন। তিনি শরৎসুন্দরী নামের এক কন্যা রেখে অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করেন।
চন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার সহধর্মিনী জ্ঞানদা সুন্দরী দেবী পাবনা জেলার বাবুলীদহ গ্রামের সুরেন্দ্রনাথকে পোষ্য গ্রহণ করেন। দেওয়ান কালীপ্রসন্ন বিশ্বাস জমিদারী দেখাশুনা করতেন।
ইতিহাস খুঁজে আরো জানা যায়, বালক সুরেন্দ্রনাথকে দেওয়ানজী গোপনে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। তারপর জ্ঞানদা সুন্দরী হান্ডিয়াল বল্লভপুর নিবাসী যোগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামে এক গরীব সন্তান পোষ্য গ্রহন করেন এবং দেওয়ানের কুদৃষ্টি হতে তাকে সযত্নে ও সর্তকতার সাথে লালন পালন করতে থাকেন। জ্ঞানদাসুন্দরী পূন্যবতী রমনী ছিলেন। সে প্রজাদের সার্থে শীতলাই গ্রামে কয়েকটি পুকুর খনন করেন এবং শিক্ষা বিস্তারকল্পে ‘শীতলাই জ্ঞানদাসুন্দরী ইংরেজী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
দেওয়ানের কুশাসনের জন্য শীতলাই জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে যায়। পরে যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র বয়োপ্রাপ্ত হয়ে স্বহস্তে জমিদারীর শাসনভার গ্রহণ করেন। তার কণ্যাণে ‘শীতলাই উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি প্রজাদের স্বার্থে কয়েকটি পুরাতন পুকুর, নাল-খালের সংস্কার করেন। তার নামেই নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় ‘যোগেন্দ্রনাথ গ্রাম’ নামে একটি গ্রাম নামকরণ হয়। গ্রামটি তার জমিদারীতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরিণত বয়সে যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র হুগলী জেলার শ্রীরামপুর এলাকার বিখ্যাত জমিদার কিশোরী লাল গোস্বামীর কন্যা সরলা দেবীকে বিয়ে করেন। সরলা দেবী চলনবিলের শীতলাই গ্রামে বসবাস করতে অনিহা প্রকাশ করায় যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র তার জন্য পাবনায় “শীতলাই বাড়ি” তৈরী করেন। এ বাড়িটিও পছন্দ না হওয়ায় তার শ্বশুর বাড়ীর অনুরুপ পাবনাতেই “শীতলাই হাউস” নামে আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি।
জমিদারীতে অনেক নাম করলেও কিছু কাজের জন্য তিনি ধিকৃত হতে থাকেন। তার শাসনে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলত এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিলো না। সে সময় মুসলমানদের গরু কোরবানী ছিল নিষিদ্ধ।
তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন “জামায়াতে উলেমার” সেক্রেটারী মাওলানা রুহুল আমীন এবং বর্তমান ভাঙ্গুড়া উপজেলার ঝবঝবিয়া গ্রামের কামাল উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে কয়েক হাজার মুসলমান প্রতিবাদ সভা করার পাশাপাশি প্রায় সপ্তাহকাল ব্যাপী জমিদার বাড়ি ঘিরে রাখেন। পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক হওয়ায় ফুরফুরা শরীফের পীর আবু বকর সিদ্দিকীর মধ্যস্থতায় এর মিমাংসা হয়। তখন থেকে যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র পাবনার শীতলাই হাউসে বাস করতে থাকেন।
যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রের ছয় পুত্র ও ছয় কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রগণ হচ্ছে, জগদীন্দ্রনাথ, বিমলচন্দ্র (যতীন), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, রণেন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথ এবং মেয়ে প্রতিভারাণী, অনিমারাণী, কলিকারাণী, শান্তিরাণী, বাসন্তীরাণী ও অন্নপূণাভ।
তথ্যে আরো জানা যায়, প্রথম পুত্র জগদীন্দ্রনাথ মৈত্র বেশ কিছু জনহিতকর কাজ করেন। যেমন, দীঘি সংস্কার, খাল খননসহ ১৩৩৮ ও ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানা খুলে জনগনের অন্নের ব্যবস্থা করেন। তার প্রচেষ্টায় পাবনায় “গান্ধী উচ্চবিদ্যালয়” (বর্তমান নাম সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ও একটি ডাকঘরও স্থাপিত হয়। ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে তার মৃত্যু হয়।
২য় পুত্র (ইঞ্জিনিয়ার) সন্ন্যাসী, ৩য় পুত্র ডাবল এম.এ রেডিও আর্টিষ্ট, ৪র্থ পুত্র আর্ট কলেজের অধ্যাপক, ৫ম পুত্র কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন ও ৬ষ্ট পুত্র গ্যাজুয়েট। দেশ বিভাগের পর এ বংশের প্রায় সকলেই ভারতে বসবাস শুরু করেন।
জমিদার বাড়ীর পার্শ্ববর্তী সিদ্ধিনগর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তিত্ব মোতালেব হোসেন জানান, এক কালে জৌলুসে ভরা ছিল শীতলাইয়ের কারুকার্য খচিত এ জমিদার বাড়িটি। বাড়ির পাশে প্রায় একশত বিঘা আয়তনের পুকুর রয়েছে। বাড়িটি আজ ভগ্নদশায় নিপতিত। নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে।
হান্ডিয়ালের আব্দুল হান্নান খোকন সহ অন্যান্যরা জানান, দেশভাগের পর এ জমিদার বংশের বংশধররা ভারতে চলে গেলে তাদের বেশ কিছু সম্পত্তি বিভিন্ন পন্থায় কব্জায় রেখেছেন অসাধুরা। সংস্কার কাজ করা হলে চাটমোহরের এ জমিদার বাড়িটি হতে পারে একটি দর্শনীয় স্থান বা পর্যটন পার্ক।
শিক্ষানুরাগী আবু ছালেক সহ স্থানীয় জনতা সরকারের নিকট দাবি করে বলেন, জমিদার বাড়িটি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে চলনবিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য।
সায়মা