
ছবি:সংগৃহীত
সকাল হলেই মাথায় বাদামের গামলা তুলে ঘর থেকে বের হন মোহাম্মদ জসিম মিয়া। রাস্তা চিনতে পারেন না, তাই হাতের লাঠিই তার দিকনির্দেশক। সঙ্গে মানুষের সহানুভূতির ভরসা। ঠোঁটে অনর্গল উচ্চারিত এক বাক্য—“আমি অন্ধ লোক, চোখে দেখি না, বাদাম নেন মা-বোনেরা, বাদাম বিক্রি করেই সংসার চলে আমার।”
৪৩ বছর বয়সী জসিম মিয়া জন্মান্ধ। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়নের হূশান নগর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের সন্তান তিনি। দু'চোখে দেখতে পান না কিছুই, কিন্তু তাতে থেমে থাকেননি। হার মানেননি। ভিক্ষার থালার বদলে বেছে নিয়েছেন বাদামের গামলা।
দীর্ঘ দুই দশক ধরে তিনি বিভিন্ন এলাকায় বাদাম বিক্রি করে সংসার চালান। গরমে আইসক্রিমও বিক্রি করেছেন তিনি, তবে আজও মূল পেশা—বাদাম বিক্রি।
“ভিক্ষা করিনি কোনোদিন। কাজ করে খাই, তাতেই শান্তি পাই,” বললেন জসিম।
স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার। বউ ঘরে বাদাম ভাজেন, আর তিনি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন সেই বাদাম বিক্রি করতে। প্রতিদিন বাদাম বিক্রি করে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, যা দিয়েই চলে তার পরিবার।
“কখনো কম, কখনো বেশি, তবে আল্লাহর রহমতে অভাব লাগেনি তেমন,” বলেন তিনি।
জসিম মিয়ার চোখে আলো না থাকলেও হৃদয়ে আছে সাহসের দীপ্তি। স্থানীয়রা বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছি। কখনোই ভিক্ষা করেননি। লাঠি ঠুকঠুক করে বাজারে আসেন, বাদাম বিক্রি করেন। এমন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা না জন্মে পারে না।”
মানিকগঞ্জ বাজারে বাদাম কিনতে গিয়ে মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল বলেন, “প্রতিদিন কত অন্ধ মানুষ দেখি ভিক্ষা করতে। কিন্তু জসিম ভাই ব্যতিক্রম। অন্ধ হয়েও তার পরিশ্রমের মানসিকতা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তার বাদামও খুবই ভালো, ভেজে রাখা থাকে যত্ন করে।”
জসিম মিয়া কোনো সরকারি ভাতা পান কি না, জানতে চাইলে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “একটু কষ্ট করে খাই, তবু সোজা পথে থাকি। তবে যদি সরকারি কোনো সহযোগিতা পেতাম, ভালোই হতো। আমার ছেলেমেয়েদের মানুষ করার স্বপ্ন দেখি।”
এই অন্ধ মানুষটি আমাদের চোখ খুলে দেন। শেখান—শরীর নয়, মন-ই পারে মানুষকে সামনে এগিয়ে নিতে। চোখে আলো না থাকলেও তার অন্তরজুড়ে যে সাহস, তাতে আলো পায় সমাজও।
জন্মান্ধ জসিম মিয়া যেন আমাদের মনে করিয়ে দেন—চোখ দিয়ে দেখা যায় জগতের রূপ, কিন্তু মন দিয়ে দেখা যায় জীবনের অর্থ। তার গল্প শুধু একটি প্রতিবন্ধী মানুষের সংগ্রামের নয়, বরং এটি এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল মানুষের জীবনের জয়গাথা।
আলীম