
ছবি: জনকন্ঠ
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে ধরণীবাড়ী ইউনিয়নে ৩৯ একর জমির উপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক মুন্সিবাড়ী।
১৮ শতকে বিনোদী লালের পালকপুত্র শ্রী ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই প্রাসাদতুল্য ভবনটি আজ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে টিকে রয়েছে, যদিও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে তা আজ ধ্বংসের মুখে।
ইতিহাসবিদদের মতে, এই বাড়ির নির্মাণের পেছনে রয়েছে একটি চমকপ্রদ কাহিনি। মহারাণী স্বর্ণময়ী দেবীর অধীনে কর্মরত হিসাবরক্ষক তথা মুনসেফ বিনোদী লাল একদিন শিকার করতে গিয়ে একটি ব্যাঙ সাপ খাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখতে পান। তৎকালীন বিশ্বাস অনুযায়ী, এমন জায়গায় বাড়ি নির্মাণ করলে সেখানে বসবাসকারী অনেক ধন-সম্পদের মালিক হন। এ বিশ্বাস থেকেই মহারাণীর অনুমতি নিয়ে বিনোদী লাল এই স্থানে বাড়ি নির্মাণ করেন।
এই স্থাপত্যে মোঘল এবং ব্রিটিশ রীতির সম্মিলনে অসাধারণ কারুকার্য ফুটে উঠেছে। বাড়ির প্রথম তলায় রয়েছে তিনটি বৃহৎ কক্ষ, যার একটিতে একসময় ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির প্রতিকৃতি টানানো ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র ভেবে বাড়িটিতে আক্রমণ চালায় এবং বেয়নেট দিয়ে প্রতিকৃতিটি ছিন্নভিন্ন করে দেয়, যা এখনও যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির স্ত্রী আশালতা মুন্সি ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা নারী। তাদের দুই কন্যা ছিল—বড় মেয়ে সুচি রাণী (টিটু) ও ছোট মেয়ে সুস্মান কান্তি (বুড়ি)। টিটুর বিবাহকে কেন্দ্র করে ব্রজেন্দ্র লাল চিন্তা করেন, তিনি যেহেতু একাধিক স্থানে বাড়ির মালিক, তার উচিত একটি মানসম্মত অট্টালিকা নির্মাণ করা, যাতে তার কন্যার বিয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিবারে দেওয়া যায়। এরপরই নির্মিত হয় দ্বিতীয় তলার ভবনটি, এবং কলকাতায় টিটুর বিয়ে হয় জাঁকজমকভাবে।
১৯৬০ সালে ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির মৃত্যুর পর, তার কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় স্ত্রী আশালতা বিহারিলাল নামে এক পুত্র দত্তক নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের বংশধররা কলকাতায় চলে গেলে বাড়িটির মালিকানা নিয়ে একাধিক মামলা-মোকদ্দমা হয়। বহুবার মালিকানা পরিবর্তনের পর বর্তমানে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, অট্টালিকার দুটি কক্ষ দীর্ঘদিন ধরে ধরণীবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে ভূমি অফিসটি বাড়ির উঠানে নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে, যদিও এখনও মূল দরজায় ‘ধরণীবাড়ী ভূমি অফিস’ লেখা সাইনবোর্ডটি ঝুলছে।
মুন্সিবাড়ী প্রাঙ্গণে রয়েছে একাধিক মন্দির, যার মধ্যে রয়েছে নাট্য মন্দির, দুর্গা মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির ও একটি উন্মুক্ত তুলসী পাঠ। এছাড়াও রয়েছে একটি বিশাল সূর্য-জলাশয় এবং অট্টালিকার ভেতরে কূপসহ বিশেষ স্থাপত্য কাঠামো। বাড়িটির একটি শিলালিপিতে ১৮৮০ সাল উৎকীর্ণ রয়েছে, যা থেকে ধারণা করা হয়—এই বছরেই মুন্সিবাড়ী নির্মিত হয়।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটির বিভিন্ন অংশ এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে কক্ষ ও বারান্দা ভিজে যায়। স্থানীয় কিছু পরিবার বারান্দায় গবাদিপশু বেঁধে রাখে, দুর্গা মন্দিরের বারান্দা জ্বালানির লাকড়ি ও পাটকাঠির গাদায় পরিপূর্ণ।
গোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত পঙ্কজ চন্দ্র মহন্ত জানান, “আমি বিগত ৩৯ বছর ধরে নিয়মিত তিন বেলা পূজা-অর্চনা করে যাচ্ছি। অথচ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই ইতিহাস।”
এলাকাবাসীর দাবি, মুন্সিবাড়ীকে ঘিরে পূর্বের মামলা নিষ্পত্তি করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এটিকে একটি ঐতিহাসিক ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে তা হতে পারে উলিপুর তথা কুড়িগ্রামের গর্ব। বর্তমানে এই অনন্য স্থাপনাটি যেন সময়ের অবহেলায় ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে।
ধরণীবাড়ীর মুন্সিবাড়ী শুধুমাত্র একটি প্রাসাদ নয়, এটি একটি যুগের সাক্ষ্য। এটি কেবল জমিদারি আমলের কাহিনি নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্থাপত্যকলার নিদর্শন ও স্থানীয় সংস্কৃতির ধারক। এখন প্রয়োজন সচেতনতা, ঐক্য এবং সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ঐতিহ্যটি সংরক্ষিত থাকে।
মুমু