ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিলুপ্তির পথে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর

মোঃ আতিকুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১৯ মে ২০২৫

বিলুপ্তির পথে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর

সময়ের প্রবাহে বদলে যাচ্ছে জীবনধারা, বদলে যাচ্ছে পেশাগত পরিচিতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সমাজের বহু চেনা দৃশ্য ও ঐতিহ্য। তেমনই এক পেশা—ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর, যাদের আর পিঁড়ি বা টুলে বসে চুল-দাড়ি কাটতে দেখা যায় না। এক সময় যাদের উপস্থিতি ছিল গ্রামবাংলার প্রতিটি হাটে, অলিগলিতে—আজ তারা প্রান্তে সরে গেছেন সময়ের চাপে।

এক সময় গ্রামীণ হাটবাজারের অপরিহার্য অংশ ছিলেন এ পেশাজীবীরা। পিঠে কাঠের বাক্স, যার ভেতরে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকিরি, আয়না, আর একটি পিঁড়ি বা জলচৌকি নিয়ে হাজির হতেন নির্ধারিত স্থানে। বৃদ্ধ, যুবক কিংবা শিশু—সবাই তাদের কাছে চুল ও দাড়ি কাটাতেন। পিতলের চিরুনি আর শাণিত কাঁচির ছোঁয়ায় গড়ে উঠত সযত্ন চুলচর্চা।

কিন্তু এখন সেই দৃশ্য বিরল। শহর তো বটেই, গ্রামীণ হাটেও চোখে পড়ে না সহজ-সরল জীবনযাত্রার এমন বহিঃপ্রকাশ। তাদের জায়গা দখল করেছে সজ্জিত জেন্টস পার্লার ও আধুনিক সেলুন। পেশার রূপান্তরে প্রযুক্তি এসেছে, অভ্যাস বদলেছে, তবে পেছনে পড়ে রয়ে গেছেন এই পেশার প্রান্তিক কারিগররা।

তবু সব হারিয়ে যায়নি। সম্প্রতি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বাজারে দেখা মেলে কিছু ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের। আজও তারা পিঁড়িতে বসিয়ে গ্রাহকের চুল ও দাড়ি কাটেন—যেমনটা করতেন বহু বছর ধরে।

তালেবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কামাল হোসেন জানালেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাটে এসে এই নরসুন্দরদের কাছেই চুল কাটাতাম। আজ আমি আমার সন্তানকে নিয়ে এসেছি। দিনমজুর মানুষ, সেলুনে গেলে খরচ পড়ে ১০০-১২০ টাকা; এখানে ৬০-৭০ টাকায় ভালো কাজ হয়ে যায়।’

মনিরুজ্জামান নামের একজন বলেন, ‘এলাকার অনেকেই আজও এই নরসুন্দরদের কাছেই আসেন। খরচ কম, কাজেও সন্তুষ্টি পাওয়া যায়।’

এই পেশার সঙ্গে অর্ধশতক ধরে যুক্ত আছেন গৌচন্দ্র শ্রী। জানালেন, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এই কাজ করছি। একসময় ২০-৩০ পয়সা ছিল চুল-দাড়ি কাটার দাম। এখন ৫০-৬০ টাকায় কাজ করি। খোলা আকাশের নিচেই প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকি। বৃহস্পতিবার ও রবিবার হাটের দিন বেশি আয় হয়। তবে আগের মতো লোকজন আসে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্থায়ী দোকান নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করি। সরকারি সহায়তা পেলে একটি দোকান করতে পারতাম।’

আরেক প্রবীণ নরসুন্দর সোদিত কুমার শীল বলেন, ‘পথের পাশে বসেই পার করেছি জীবনের ৩০-৪০ বছর। এই পেশাই আমার সংসার চালানোর একমাত্র ভরসা।’

ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের আয় নির্ভর করে হাটের দিনের ওপর। একজন কর্মীর দিনে আয় হয় গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা, কোনো কোনো দিন তা হাজার ছুঁয়েও যায়। তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ খুবই সাধারণ: কাঁচি, ক্ষুর, চিরুনি, শেভিং ক্রিম, আয়না ও একটি টুল বা পিঁড়ি। সহজসাধ্য এই সেবার কারণে এখনও বহু মানুষ তাদের প্রতি আস্থাশীল।

তবে কালের স্রোতে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে তাদের পরিসর। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন, নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অথচ এই পেশা ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাটবাজারের পথঘাটে এখনো যেসব ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছেন, তারা আসলে একটি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার নিঃশব্দ সংগ্রামী।এই পেশায় ৬০ বছর পার করেছেন এমনও আছেন অনেকে। এ সময়ে বাজারের চিত্র বদলে গেলেও বদলায়নি তাদের জীবন। স্বল্প আয়ের এই টাকা দিয়েই চলে তাদের পরিবার।

 

রাজু

×