
ছবি : জনকণ্ঠ
শেষ বৈশাখের উত্তপ্ত রোদের তাপে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কার মধ্যে বিরামহীনভাবে ধান কাটছেন শামছুদ্দিন ও নুরুন্নাহার দম্পতি। শামছুদ্দিনের নিজের কোনো জমি নেই। বর্গাচাষ করেই তার সম্বল ৮০ শতক জমি। এই জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি দিনমজুরি করে চালাতে হয় সংসারের খরচ।
শামছুদ্দিন-নুরুন্নাহার দম্পতি জানান, ধান কাটার জন্য তারা কম্বাইন হারভেস্টার পাচ্ছেন না। হারভেস্টার মেশিন মালিকের কাছে গেলে চাওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। অতিরিক্ত টাকা দিতে রাজি হলেও দেওয়া হচ্ছে কয়েকদিনের লম্বা সিরিয়াল। অন্যদিকে রয়েছে শ্রমিক সংকট ।
তারা বলেন, শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি—তিন বেলা খাইয়ে দৈনিক ১,০০০ থেকে ১,১০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। দু-একজন শ্রমিক মিললেও তারা দৈনিক মজুরি ১,০০০ টাকার নিচে কাজ করতে রাজি হচ্ছেন না। এ অবস্থায় নিজেদেরই ধান কেটে বাড়িতে এনে মাড়াই করতে হচ্ছে এই দম্পতিকে।
শামছুদ্দিন-নুরুন্নাহার দম্পতি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চর ষোলহাসিয়া গ্রামের বাসিন্দা। শুধু তারাই নয়—ময়মনসিংহ জেলাজুড়ে হারভেস্টার মেশিন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও কৃষি শ্রমিক সংকটের কারণে বহু কৃষক স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এছাড়াও কৃষকদের ক্ষুব্ধ করছেন ধান ব্যবসায়ীরা। তারা ন্যায্য দাম না দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি মণ ধানে অতিরিক্ত ২-৩ কেজি রেখে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কৃষকরা জানান, এ বছর কীটনাশক, সার ও শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি গুনে ধান চাষ করেছেন। এতে ব্যয়ও বেড়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ কৃষকের বোরো ধান পেকে গেছে। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই ধান কাটা এখন জরুরি। কিন্তু ১০ শতাংশ জমির ধান কাটতে হারভেস্টার মালিকদের ১,০০০–১,২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। নির্ধারিত ভাড়া কম দিলে তারা ধান কাটছেন না।
ময়মনসিংহের স্থানীয় কৃষি অফিস বলছে, গত বছর ২ লাখ ৬৩ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩০ হেক্টর, উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫২ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫–৭০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। বর্তমানে জেলায় হারভেস্টার মেশিন রয়েছে ২৯৪টি, যার মধ্যে প্রায় ৩০টি নষ্ট। শুধুমাত্র ময়মনসিংহ সদরে হারভেস্টার আছে ১৬টি—সব সচল।
সূত্র জানায়, সরকারি নির্ধারিত ভাড়ামতো এক একর (১০০ শতক) জমির ধান কেটে নেওয়ার সর্বোচ্চ ভাড়া ৫,৪০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০ শতকে ভাড়া হওয়া উচিত ৫৪০ টাকা।
সদরের চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, “জমির সব ধান পেকে গেছে। ১০ শতাংশ কাটতে ১,০০০–১,২০০ টাকা চাচ্ছে হারভেস্টার মালিকরা। তাদের দাবি মেনে নিলেও সিরিয়াল মিলছে না।”
ক্ষোভ প্রকাশ করে একই ইউনিয়নের খালপাড় এলাকার কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, “ধান বিক্রির সময় এক মণ ধানের সঙ্গে ৩ কেজি বেশি নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। অথচ সব ধান শুকনা। বাড়তি ধান না দিলে তারা নিচ্ছে না।”
ময়মনসিংহ মহানগরীর শম্ভুগঞ্জ ধান ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, “ব্যবসায়ীরা কৃষকদের বাধ্য করে বাড়তি ধান নিচ্ছেন। আমি মনে করি, এটি কৃষকদের সঙ্গে জুলুম। আমি সব ব্যবসায়ীকে নিষেধ করেছি। তারা শুনছে না। কৃষকদের স্বার্থে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো দরকার।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু বলেন, “প্রতি ১০ শতক জমির ধান কাটার জন্য ৫৪০ টাকার বেশি নেওয়ার অনুমতি নেই। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ধান বিক্রির সময় ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত ধান রাখছেন কি না, তা জানা নেই। বিষয়টি জেলা প্রশাসন বা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নজরে আনা হবে।”
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগের উপপরিচালক রিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “বাড়তি ধান নিয়ে কৃষকদের ঠকানো যাবে না। তবে আমাদের কাছে ধান পরিমাপের যন্ত্র নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। যন্ত্র পেলে বাজারে অভিযান চালানো হবে।”
সা/ই