
ছবি সংগৃহীত
নোয়াখালীর বিশাল চরাঞ্চল এখন ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীত। সময়টা এখন খেজুর রসের। গাছিরা খেজুর গাছ থেকে নামাচ্ছে সুস্বাদু মিষ্টি রস। টাটকা রসের স্বাদ পেতে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের পূর্বেই খেজুর রস খাওয়ার জন্য শহরের অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা বিভিন্ন মহল্লায় প্রতিদিনই ভিড় করছে মানুষ।
মেঘনাবক্ষে জেগে উঠা অসংখ্য চরের গ্রামীণ জনপদের দুই পাশে সারি সারি খেজুর গাছ। প্রতিদিন ভোর থেকে গাছে ঝুলে থাকা রসের হাঁড়িগুলো নামিয়ে আনেন গাছিরা। এ সময় নিচে অপেক্ষা করেন টাটকা রসের স্বাদ নিতে আসা নানা বয়সী লোকজন। খেজুরের রস শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিড় লেগেই থাকে।
বৃহস্পতিবার সকালে চরাঞ্চলের বিভিন্ন মহল্লায় দেখা যায়, একজন গাছি খেজুর রসের হাঁড়ি কাঁধে ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আর লোকজন গ্লাসে গ্লাসে টাটকা মিষ্টি রস পান করছেন। প্রতি গ্লাস রস ১০ টাকা, আবার এক কেজি রসের দাম ৪০ টাকা। অনেকেই নিজে খেয়ে পরিবারের জন্যও নিয়ে যাচ্ছেন।
খেজুরের রস ও রস পিঠাসহ খেজুরের গুড় বাঙালির পুরনো ঐতিহ্যবাহী খাবার। শীতের আগমনের পর টাটকা মিষ্টি রসের স্বাদ নিতে আসেন নানা বয়সী লোকজন। অন্যদিকে গাছিরা ভোর থেকে গাছ থেকে রস নামানো শেষ হলে ছুটেন বাজারের দিকে। কারন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের স্বাদও কমে যায়।
কথা হয় রসের স্বাদ নিতে আসা তৌফিকা করিমের সাথে। তিনি বলেন, “শীতের সকাল, টাটকা খেজুরের রস খেতে ভারি মজা। রসের নেশা আমার পিছু ছাড়ে না। তাই শীত আসলেই রস খুঁজে বেড়াই। ছোট বেলা থেকেই খেজুরের রস খেতে আমার অনেক ভালো লাগে। খেজুর রসের স্বাদই আলাদা। এই রসের যে একটি মিষ্টি গন্ধ আছে, যেটি অন্য কোনো রসে নেই। ১০ টাকা করে ২ গ্লাস খেলাম।”
রস কিনছিলেন কলেজ শিক্ষক মাসুদ মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি বলেন, “শীতের সকালে ছোট বেলায় নিজেদের গাছের রস বড় গ্লাসে করে নিয়ে মুড়ি দিয়ে ভিজিয়ে খেতাম। এখন কিনে খেতে হচ্ছে। ৪০ টাকা কেজি দরে বাড়ির জন্য ৫ কেজি রস নিলাম।”
এ সময় কথা হয় গাছ থেকে রস নামানো আবুল হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, “আমার বাড়ি চেয়ারম্যানঘাট। শীত আসলেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খেজুরের গাছ থেকে রস নামাই। এটা আমার বাপ—দাদার ব্যবসা। বছরে ছয় মাস এই ব্যবসা করে পুরো বছর চলি।”
তিনি আরো বলেন, “এই শীত মৌসুমে আমি ৩০টি খেজুর গাছ থেকে রস পাচ্ছি। প্রতিদিন এসব গাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ কেজি রস নামাই। ভোর বেলা থেকে রস নামাতে থাকি, তা আবার বেলা বাড়ার আগে বিক্রি করে শেষ করি। এ থেকে দিনে ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকার রস বিক্রি করি। এ আয় দিয়ে আমার সংসার চলে।”
প্রকৃতিতে এখন পুরোপুরি লেগেছে শীতের ছোঁয়া। দিনে খুব একটা অনুভব না হলেও সূর্য ডুবতেই আর শেষ রাতে ছড়িয়ে পড়ে শীতল হাওয়া। বর্ষপঞ্জিতে পৌষ ও মাঘ শীতকাল। তবে তারও আগে প্রকৃতিতে নিজের রূপ প্রকাশ করে এই ঋতু। শীতের পরশ বুলিয়ে কুয়াশার চাদরে আগলে নেয় চারদিক। শীতের মনোমুগ্ধকর এমন রূপ অনেকের কাছেই প্রিয়, আর প্রিয় খেজুরের রস।
টাটকা রসের স্বাদ পেতে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে ভোরবেলা ছুটে যান দূর—দূরান্তে। গ্রামীণ পরিবেশে দুই পাশে সারি সারি খেজুর গাছ যেন রসের জন্য আর্তনাদ বাড়িয়ে দেয়। খেজুর গাছের চারপাশ পরিণত হয় রসপিপাসুদের কেন্দ্রস্থলে। কখন গাছ থেকে হাঁড়িগুলো নামাবেন গাছিরা, কখন খাবে এই শীতের মধু। খেজুরের রস খাওয়ার পাশাপাশি খেজুর গাছ এবং খেজুরের রস নিয়ে ছবিও তোলেন অনেকে। তেমনই একটি ঘটনার বর্ণনা দিলেন ভ্রমণপিপাসুরা।
শীতের রাত। ঠান্ডা প্রকৃতি উপভোগ করতে বের হলাম বাইরে। ফেসবুকে ঘাটাঘাটি করে খেজুর গাছ আর রস খাওয়ার ছবি দেখে আমারও ইচ্ছে হলো রস খাওয়ার; কোথায় পাওয়া যাবে? সঙ্গে ছিল ক্যাম্পাস জীবনের এক ছোটভাই। তার কাছেই জানতে চাইলাম প্রথম। শান্ত ও খোশ মেজাজের ছেলেটি সঠিক বলতে পারল না।
এরপর ফোন দিলাম নিঝুম দ্বীপের পাশে বসবাসরত আরেক স্নেহের ছোটভাইকে। জিজ্ঞেস করলাম, খেজুরের রস কোথায় পাওয়া যাবে? সে বলল, খেজুর গাছের সন্ধান তার কাছেই আছে। কাল খুব ভোরে বাড়িতে চলে আসতে। ভোর ছাড়া নাকি রসের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না।
ভোরে সঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য আমি আমার সাথের হানিফ ভাইকে মাইক্রোতে নিয়ে মাঝরাতেই ঢাকা ছেড়ে রওনা দিলাম টাংকিরহাটের উদ্দেশ্যে।
টাংকিরহাট পৌঁছানোর পর তিনজন মিলে শুরু হলো চাঁদের আলোয় অন্ধকারে পথচলা। গ্রামে সুনসান নীরবতা। কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া। কাঁচা রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছলাম এক গ্রামে। সেখানকার এক খেজুরগাছির সঙ্গে আলাপ হলো। এরই মাঝে ভোর হয়ে এসেছে। শেষরাতের আবছা আলোয় কোমরে দড়ি বেঁধে গাছি ভাই নিজের গাছে উঠলেন। নামালেন টাটকা খেজুর রস। গাছ থেকে নামানো মাটির হাঁড়ি দেখে মন ভরে উঠল। বহুদিন পর খেজুরের রস খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। ফিরে গেলাম শৈশবে।
আমার বিশ্বাস, এ দেশের বহু শিশু—কিশোরের সঙ্গে শীতকালের খেজুর রসের স্মৃতি আছে, আছে মাঝরাতে গাছে উঠে রস খাওয়ার আনন্দ। শহরের জীবন আমাদের এমন অনেক শৈশবকে বানিয়ে দিয়েছে শুধুই স্মৃতি। তবে সেই স্মৃতি বড়ই মধুময়। মাঝেমধ্যে চাঁদনী রাতে সেই স্মৃতি ফিরে পেলে মন্দ হয় না।
একটা সময় ছিল যখন খেজুর গাছ ছিল গ্রামীণ মানুষের জীবিকার মাধ্যম। এই পেশার সাথে জড়িত ছিল গ্রামীণ নারীরাও। কোমর বেঁধে তারা গুড় তৈরির কাজে নেমে পড়তেন। শীত এলে গাছিরা ধারালো দা, কোমরে দড়ি বেঁধে গাছে উঠে হাঁড়ি বসাতেন। সকাল বেলা হাঁড়িভর্তি রস নামাতেন। ওই রস ও তৈরি গুড় বিক্রি করে চালাতেন সংসার। তবে কালের পরিক্রমায় হারাচ্ছে খেজুর গাছ, কমেছে গাছি।
আবহমান বাংলার বাঙালীর চিরচেনা শীত মৌসুমে খেজুরের রসবিহীন গ্রাম সংস্কৃতির কথা কল্পনা করা যায় না। শীত মৌসুমে গ্রামের উৎসব—পার্বণে নানা ধরনের পিঠা—পায়েস তৈরির যে মহা আয়োজন চলে, তার শীর্ষ উপকরণ খেজুরের রস এবং এই রস দিয়ে তৈরি নানা ধরনের গুড়। মায়েরা পরস্পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কিংবা ছেলের শ্বশুরবাড়ি রস ও রসের গুড় দিয়ে তৈরি বিচিত্র ধরনের পিঠা—পায়েস পাঠানো অবশ্যকর্তব্য মনে করতেন। একইভাবে রস ও রসের গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা—পায়েস প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টন করাও বঙ্গ সংস্কৃতির অংশ।
তবে কয়েক বছর ধরে খেজুরগাছে যেখানে মাটির ঠিলা পেতে রস সংগ্রহ করা হয়, সেখানে রাতের বেলা বাদুড়ের হানায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে নিপাহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ভয়াবহ প্রাণঘাতী। ফলে খেজুরের রস নিয়ে চিরন্তন গ্রামীণ উৎসবে এক ধরনের ভীতিও তৈরি হয়েছে। তবে রস সংগ্রহে বর্তমানে নানা ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কাঁচা রস পানে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। অবশ্য রস যখন আগুনের চুলার ওপর দেওয়া হয়, তখন আর ভাইরাসের জীবাণু থাকে না।
আশিকুর রহমান