ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সুন্দরবনে আগুন: ড্রোনের মাধ্যমে চলছে মনিটরিং 

 স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ৬ মে ২০২৪

সুন্দরবনে আগুন: ড্রোনের মাধ্যমে চলছে মনিটরিং 

আগুন পুড়ে যাওয়া সুন্দরবনের গাছ

  • ৭ সদস্যের উচ্চ কমিটি 

‘পূর্ব সুন্দরবনো চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির অদূরে লতিফের ছিলা নামক সংরক্ষিত বনাঞ্চলে লাগা আগুন দৃশ্যত নিভে গেছে। তবুও আরও দু’দিন নিবিড় পর্যবেক্ষনের পর নির্দিষ্ট করে বলা যাবে আগুন পুরোপুরি নিভেছে। কেননা বাইরে থেকে দেখা না গেলেও ভেতরে গাছের শিকড়ে অনেক সময় আগুন থেকে যায়, যা পরে আবার জ্বলে বিস্তৃতি লাভ করে। এজন্য ড্রোন দিয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে।’’ সরেজমিনে আগুন নির্বাপনে সার্ব্বিক তত্ত্বাধানে থাকা খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো সোমবার সন্ধ্যায় (৬ মে) জনকণ্ঠকে একথা বলেন।  এদিকে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুনের ঘটনায় বনজ সম্পদ ও জীব বৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ এবং পরবর্তিকরণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্দেশে উচ্চ পর্যায়ের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো-কে সভাপতি এবং খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ) নির্মল কুমার পালকে সদস্য সচিব করে ৭ সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রফেসর ম্যানগ্রোভ ইকোলজিস্ট ড. স্বপন কুমার সরকার, খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রফেসর ড. এস এম ফিরোজ, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি-এর প্রতিনিধি। এ কমিটি আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে উল্লেখিত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সোমবার সন্ধ্যায় প্রধান বন সংরক্ষক মো: আমীর হোসাইন চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রে এ কমিটি গঠনের তথ্য জানা যায়।

আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে তৃতীয় দিন (সোমবার) ভোর থেকে আবার কাজ শুরু হয়। অগ্নিকান্ডের এলাকায় পানি ছিটানো শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগেরকর্মী, কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্রুপ (সিপিজি), ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের (ভিটিআরটি), টাইগার টিমসহ স্থানীয় সেচ্ছাসেবী ও বনজীবীরা। পাশাপাশি তাদের সহযোগীতা করেন নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ডের একাধিক টীম।

প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁর নির্দেশে রবিবার রাতে ২০ জনের একটি টিম বনে সর্তক পাহারায় ছিলেন।
আগুনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সার্ব্বিক তত্ত্বাধানে থাকা খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, “প্রধান বন সংরক্ষক স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক রবিবার সারা রাত ২০ জনের বন কর্মী দলভিত্তিক নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইকুপমেন্টের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। সারারাত চেষ্টার মাধ্যমে যে সমস্ত জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ও ধোঁয়া দেখা গিয়েছিল সবগুলোই নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বলা চলে সুন্দরবনের আগুন এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। তবে যেহেতু বনের আগুন, শতভাগ নিশ্চিত ভাবে এখনই বলার সুযোগ নাই যে আগুন পুরোপুরি নিভে গেছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মাটির গভীরে গাছের শিকড়ের মধ্যেও আগুন থেকে থাকে। যা পরবর্তীতে কয়েক ঘণ্টার পরে পুনরায় আগুনের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। কাজেই যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আগামী তিনদিন বন বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং, যেকোনো সময়ে অগ্নি নির্বাপনের সার্বিক প্রস্তুতি চলমান থাকবে।’

আগুন লাগার স্থলে মনিটরিং সম্পর্কে তিনি বলেন, আগুন এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে উক্ত স্থানে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এখন ড্রোনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। ড্রোনের মাধ্যমে মনিটরিং এর দ্বারা আজ (সোমবার) তিনবার আগুনের ধোঁয়া শনাক্ত করে তা দ্রুত নিভিয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে ঘটনাস্থলে বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ দায়িত্বরত আছেন।”

আগুনের কোন প্রকার শঙ্কা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আজ থেকে আগামী তিন দিন পর্যন্ত ঘটনাস্থলে বন বিভাগের টহল দল আগুন মনিটরিং করবে। কোন স্থানে নতুন কোন আগুনের সূত্রপাত ঘটলে তা সাথে সাথে নিভিয়ে ফেলা হবে। ফায়ার সার্ভিসের টিমও আগামীকাল (মঙ্গলবার) ঘটনাস্থলে থাকবেন। আগুন দৃশ্যত: নিভে যাওয়ায় সোমবার বিকেলে কোস্টগার্ড, নৌ বাহিনী এবং বিমান বাহিনীর সদস্যগণ ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন।’

আগুন লাগার কারন সম্পর্কে তিনি বলে, সুন্দরবন লোকালয়সংলগ্ন নদী এবং খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে বনভূমি প্লাবিত না হওয়ায় এর আগেও বিভিন্ন সময় এই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এখানে মাটির উপর কয়েক ইঞ্চি পুরু জৈব পদার্থ(লতাপাতা ও ডাল-পালা) মজুদ হয়ে আছে। কাজেই এই তীব্র গরমে সেখানে নিচের দিকে মিথেন গ্যাস মজুদ হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

আবার লোকালয়সংলগ্ন হওয়ায় কোন ব্যক্তি বনে প্রবেশ করলে তার ফেলে দেওয়া বিড়ি বা’ সিগারেটের আগুন থেকে সূত্রপাত হতে পাবে। এছাড়া, মধু আহরণের মৌসুমি হওয়ায় মৌয়ালদের মৌচাক ভাঙ্গার আগুন থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শুকনো ডালের ঘর্ষনেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।’ তবে আগুন লাগার সঠিক কারন জানতে তদন্ত চলছে। এব্যাপারে স্থায়ী সমাধানের লক্ষে চেষ্টা চালানো হবে। গঠিত তদন্ত কমিটি আগামী ৭ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।  

এদিকে রবিবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর প্রধান বন সংরক্ষক মো: আমীর হোসাইন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু রাতে নির্বাপন কাজ স্বাভাবিক ভাবে করা যায় না, তাই আগুন যাতে বাড়তে না পারে সে কারনে ২০ জনের একটি টিম রাতেও কাজ করছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের ৫ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে।’ তবে একই স্থানে বার বার আগুন লাগার বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন এবং সুন্দরবনের ভরাট নদী-খাল খননে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত মোরেলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম তারেক সুলতান সোমবার বিকেলে বলেন, শনিবার উক্ত স্থানে লাগা আগুন সম্পূর্ণ নেভাতে সোমবার ভোর ৬টা থেকে পানি দেওয়া শুরু হয়। বিকেলে কোথাও আগুন জ্বলতে দেখা যায়নি। আশা করছি আগুন নিভে গেছে।

প্রসঙ্গত: সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগেছিল। এ নিয়ে গত ২৩ বছরে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন ওই এলাকায় অন্তত ২৫ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল। এসব ঘটনায় প্রায় দেড়’শ একর বনভূমি পুড়েছে। 

শহিদ

×