
রস জ্বাল দেওয়ার পর গুড় তৈরির জন্য হাঁড়িতে ঢালছেন এক মহিলা
যশোরের বিভিন্ন গ্রামে এখন চলছে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের মৌসুম। পুরুষ মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাঠে ছোটেন খেজুরগাছ থেকে রসের ভাড় নামাতে। আর মহিলারা সেই রস জ্বাল দিয়ে তা থেকে তৈরি করেন স্বাদের পাটালিগুড়। তা ছাড়া পিঠা, পায়েশ তৈরি হয় রস দিয়ে, নলেন পাটালি দিয়ে। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এলে রস এবং পাটালি দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েশ তাদের চাই-ই। এটা এখন মেহমানদের দেওয়ার প্রথম আহার।
যশোর-মাগুরা সড়কে খাজুরা বাজার। এই খাজুরার পাটালি এবং গুড় সারাদেশে নাম করা। আর খাজুরা বাজার গড়ে উঠেছে মথুরাপুর, তেলিধান্য, পান্তাপাড়া, গহরপুর, তেজরোল গ্রামকে নিয়ে। খেজুর গাছের আধিক্যের কারণেই বাজারের নাম হয়েছে খাজুরা বাজার।
কয়েকদিন আগে এক সকালে খাজুরা বাজারের পাশে এনায়েতপুর গ্রামে সানাউলাহর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে তার স্ত্রী উনুনে খেজুর রস জ্বাল দিচ্ছেন। সানাউলাহ জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি খেজুর গাছ কাটেন। আগে প্রতি শীতের মৌসুমে পাঁচপণ (৮০টি খেজুর গাছে একপণ) খেজুরগাছ থেকে তিনি রস সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এলাকায় খেজুরগাছ কমতে থাকায় এখন তিনি প্রতি শীত মৌসুমে ২ পণ খেজুর গাছ থেকে রস বের করেন। এরমধ্যে তার নিজের একপণ। বাকি গাছগুলো লিজ নেওয়া। ৬টি খেজুর গাছপ্রতি তার ১ ভাড় (৭ কেজি) গুড় দিতে হয় মালিককে। তিনি জানান, এবার নভেম্বর মাস থেকেই তিনি গাছ কেটে রস বের করছেন।
এত আগে থেকে এর আগে তিনি খেজুরগাছ কাটেননি। এবার শীত একটু আগে আসায় এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এই অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশি থাকলেও এবার নভেম্বর মাস থেকেই মৃদু শীতের অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে। তাই অক্টোরের প্রথম দিকেই তিনি খেজুরগাছ প্রস্তুত করেছিলেন। আর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে গাছ কাট শুরু করেছেন। রস হচ্ছে অল্প। এই মাসের শেষ নাগাদ গাছে রস বেশি পাওয়া যাবে বলে তার বিশ^াস। তবে রস কম হলেও সবটুকু রস দিয়ে তিনি পাটালি তৈরি করছেন। কারণ, এখনকার পাটালি খেতে খুব সুস্বাদু এবং দাম বেশি। কয়েকদিন ধরে তিনি প্রতি কেজি পাটালি বিক্রি করছেন ৬শ’ টাকা কেজি দরে।
পাশের তেজরোল গ্রামের আব্দুস সামাদ বলেন, শীতের তীব্রতা এখনো আসেনি। তারপরও তিনি গাছ কাটছেন। অল্প রস হচ্ছে। তিনিও পুরো রস দিয়েই পাটালি তৈরি করছেন। তার আশা এবার যদি নভেম্বর মাসে নি¤œচাপ সৃষ্টি না হয়, তাহলে ভালো রস পাবেন খেজুরগাছ থেকে। তিনি আরও বলেন, আগে খেজুর গুড় এবং পাটালির দাম পাওয়া যেত না। গত বছর থেকে খেজুরের গুড় এবং পাটালির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আমরা গুড় এবং পাটালিতে ভেজাল দেই না। যেহেতু বেশি দামে পাটালি বিক্রি করতে পারছি, তাই অনেকে খেজুরগাছ আবার নতুন করে তোলার পাশাপাশি শীতে এটা পেশা হিসাবে নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আকাশ মেঘলা থাকলে রস ঘোলা হয়ে যায়। এতে পাটালি এবং গুড়ের স্বাদ ও মান কমে যায়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি খেজুরগাছ থেকে রস পাবেন বলে আশা করছেন।
এনায়েতপুরের সানাউল্লাহর স্ত্রী জানান, ফজরের নামাজের পর তার স্বামী মাঠে যান খেজুরগাছ থেকে রস নামাতে। গত বছর প্রতিদিন তাদের কম করে হলেও ৭/৮ ভাড় ‘জিরেন রস’ হতো। এই রস জ্বাল দিয়েই তৈরি করা হতো সুস্বাদু পাটালি। এ বছর কেবল গাছকাটা শুরু হয়েছে। প্রতি দুই ভাড়ের বেশি এখনো রস হয়নি। সবটুকু জ্বালিয়ে পাটালি তৈরি করে তার স্বামী বিক্রি করেন।
খেজুরের পাটালির বৈশিষ্ট্য-সারা মৌসুম ওই পাটালির নলেন স্বাদ থাকে। সেখানকার পাটালি যারা তৈরি করেন, তারা সবাই রস জ্বাল দেন কাঠের আগুনে। এ ছাড়াও এক সপ্তাহ পর পর গাছ কেটে রস বের করা হয়। এতে সপ্তাহে একদিন রস পাওয়া গেলেও সেই রস দিয়ে পাটালি তৈরি করলে তার স্বাদ থাকে নলেন। তাছাড়া গাছে উঠে কয়েকবার করে চান্দি মুছে দিয়ে আসে গাছি। এতে দ্রুত শুকিয়ে যায় কাটা স্থান। ফলে যা রস পাওয়া যায়, তা হয় পরিষ্কার। সেই পরিষ্কার রসের গুড় এবং পাটালির স্বাদ হয় ভালো।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাই। এক সময় যশোরের খেজুরগুড় থেকে ব্রাউন চিনি তৈরি হতো। তার জন্য যশোরের কয়েক স্থানে কারখানা গড়ে উঠেছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় কারখানা ছিল চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পাশে তাহিরপুরে। সম্প্রতি তাহিরপুরে গিয়েছিলাম সেই কারখানার ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
আসলে যশোর জেলার মানচিত্রে এখন আর তাহিরপুরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর দশ-পাঁচটা সাধারণ গাঁয়েরই একটি তাহিরপুর। সারি সারি খেজুর বিথি। আছে আম, জাম, কাঁঠালের নিবিড় বাগান। হলুদ ক্ষেত। জমাট স্তব্ধতা ভেদ করে মাঝেমধ্যে পাখ-পাখালির কলগীত। ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর। কাঁধে লাঙল নিয়ে মাঠে ছোটেন চাষিরা। তপ্ত মধ্যাহ্নে পাশের শীর্ণকায় কপোতাক্ষী নদীতে চরে বেড়ান গরু-ছাগলের পাল তৃষ্ণা নিবারণ করে। লোয়ার ভৈরব নদীর বিশুদ্ধ খাতের ধারে ঝোপ-ঝাড়। দিবসে শেয়াল বেজির নির্ভর অভয়ারণ্য।
অথচ এক সময় কারখানার ভোঁ ভোঁ বাঁশির শব্দে খুব ভোরে ঘুম ভাঙত গ্রামবাসীর। শ্রমিকরা ছুটতেন কারখানা পানে। চিমনির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হতো চৌদিক। জম-জমাট নগর জীবনের ছোঁয়া নিয়ে দিন যাপন করতেন তাহিরপুরের লোকজন। নদীর ঘাটে এসে ভিড় করত দেশী-বিদেশি জাহাজ। আজকের তাহিরপুর সেদিনের তাহিরপুরের কঙ্কাল মাত্র। কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়-তাহিরপুর অতীতের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিল বাণিজ্যিক কারণে। মেজর রেনেল অংকিত মানচিত্রেও তাহিরপুরকে দেখানো হয়েছে বিশিষ্ট বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে। যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর (১৮৬৮-১৮৭২) মি. জে ওয়েস্টল্যান্ড তার ‘রিপোর্ট অন যশোর’ গ্রন্থেও তাহিরপুরকে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
তাহিরপুর চৌগাছা উপজেলার একটি গ্রাম। চৌগাছা থেকে সোজা উত্তরে ১৬ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর শহর। এরই মাঝামাঝি এলজিইডির রাস্তার হাকিমপুর বাজার থেকে পশ্চিমে ১ কিলোমিটার গেলেই তাহিরপুর। এখন এই রাস্তাটিও পাকা। কপোতাক্ষ নদী এই গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণগামী হয়েছে। এই গ্রামের দক্ষিণ প্রান্ত থেকেই লোয়ার ভৈরব নদী বের হয়েছে কপোতাক্ষ হতে। অর্থাৎ তাহিরপুর হলো কপোতাক্ষ ভৈরবের সঙ্গমস্থল। অতীতে যে কারণে এখানে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশের প্রথম যান্ত্রিকভাবে চিনি তৈরির কারখানাও স্থাপিত হয়েছিল এই তাহিরপুরে।
যশোর জেলায় চিনি উৎপাদিত হতো বহুকাল আগে থেকেই। অবশ্য সে চিনি আখ থেকে নয়, তৈরি হতো খেজুরের গুড় থেকে। এই জেলায় আজকের মতো অতীতেও সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশির খেজার গাছ জন্মাত। খেজুরের গুড় একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় রাখা হতো মাটির ভাড় বা হাঁড়িতে। এরপর কপোতাক্ষ নদীতে জন্মানো এক ধরনের শৈবাল, যা স্থানীয় ভাষায় ‘পাটা শেওলা’ নামে পরিচিত, তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো ওই গুড়। দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পর শেওলা তুলে নিলে দেখা যেত ওই গুড় সম্পূর্ণ চিনিতে পরিণত হয়েছে। এই চিনিই বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে সরবরাহ করা হতো। রপ্তানি হতো বিদেশেও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশ থেকে, যে প্রচুর চিনি আমদানি করত, তার প্রমাণ মেলে সেই সময়কার বিভিন্ন কাগজ-পত্রে।
বিদেশে চিনি রপ্তানি শুরু হওয়ায় যশোরের খালিসপুর, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, বয়রা, বনগাঁ, মোল্লাহাট, গঙ্গানন্দপুর, বোতখানা, ঝিকরগাছা, খাজুরা, রাজারহাট, রূপদিয়া, তালা, বসুন্দিয়া, ফুলতলা, কালীগঞ্জ, নোয়াপাড়া, যাদবপুর (নাভারন), ইছাখাদা, কেশবপুর, ত্রিমোহিনী প্রভৃতি স্থানে অসংখ্য চিনি কারখানা গড়ে ওঠে। এসব স্থানে প্রাচীন পদ্ধতিতে অর্থাৎ পাটা শেওলা দিয়েই চিনি তৈরি হতো। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮৭৪ সালে একমাত্র কোটচাঁদপুরের কারখানাগুলো থেকেই ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৫ মণ চিনি পাওয়া যায়। অন্য এক হিসাবে (যশোর গেজিটিয়ার) দেখা যায়, ১৯০০-০১ সালে সমস্ত বাংলাদেশে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ চিনি উৎপাদতন হয়। এরমধ্যে শুধু যশোরেই উৎপাদন হয় ১৭ লাখ ৯ হাজার ৬০ মণ চিনি।
নীল চাষের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে ইংল্যান্ড থেকে কিছু ব্যবসায়ী চিনির ব্যবসা করতে আসেন। তাদের একজন মি. ব্লেক। মি. ব্লেক প্রথমে বাংলার (ভারত) বর্ধমানের ধোবা নামকস্থানে একটি কুঠি নির্মাণ করে প্রাচীন পদ্ধতিতে চিনি উৎপাদন শুরু করেন। কিন্তু চিনি তৈরির কাঁচামাল বা গুড় উৎপাদিত হয় যশোর জেলায়। ফলে, বর্ধমানে যশোর থেকে গুড় আমদানি বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। তার কারখানাটি লোকসান দিতে থাকে। তিনি কোটচাঁদপুর (বতমানে ঝিনাইদহ জেলার একটি উপজেলা) ও ত্রিমোহিনীতে (যশোরের কেশবপুর উপজেলা) এসে চিনি তৈরির কারখানা খোলেন।
মি. সেন্টসবারি নামক এক ইংরেজও ত্রিমোহিনীতে কারখানা বসান। মি. নিউ হাউসের কারখানা ছিল কোটচাঁদপুরে। ‘গ্লাডস্টোন অ্যান্ড উইলি কোম্পানি’ও চৌগাছাতে কারখানা স্থাপন করেন। এসব কারখানা চিনি তৈরিতে ব্যবহার করা হতো পুরনো পদ্ধতি। দেশীয় উৎপাদকের তুলনায় তাদের উৎপাদন খরচ পড়ত বেশি। যে কারণে তারা শেষ পর্যন্ত তাদের কারখানা তুলে দেন।
সবাই এভাবে চিনি কারখানা তুলে দিলেও মি. নিউ হাউস তা না তুলে নতুন করে এতে পুঁজি বিনিয়োগে মনস্থ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন-যান্ত্রিক উপায়ে চিনি প্রস্তুতের। অনেক স্থান দেখার পর তার পছন্দ হয় তাহিরপুর। তাহিরপুর পছন্দ হওয়ার পেছনে প্রথম কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধা। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সঙ্গমস্থল হওয়ায় যেমন এখান থেকে সুদূর উত্তরে যাতায়াত সম্ভব ছিল, তেমনি যাওয়া যেত দক্ষিণেও। আর ভৈরব নদী থেকে গোটা পূর্বাঞ্চলে ছিল তাহিরপুরের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখ্য, তখন কপোতাক্ষ নদী ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদী।
১৮৬১ সালে তাহিরপুরে চিনিকল স্থাপতি হয়। চিনিকলের যন্ত্রপাতি আনা হয় ইংল্যান্ড থেকে। চিনির পাশাপাশি কারখানার আয় বৃদ্ধিতে তাহিরপুরে উন্নতমানের ‘রাম মদ’ তৈরির কাজেও হাত দেন মি. নিউ হাউস। এখন থেকে মদ রপ্তানি হতো ইউরোপেও। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত চিনিকলটি চালানোর পর মি. নিউ হাউস এটি বিক্রি করে দিয়ে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি কিনে নেন ‘এমেট অ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারা চিনিকে আরও সাদা ধবধবে করার জন্য গুড়ের সঙ্গে হাড়ের গুড়া মিশাতেন। কিন্তু তারা কারখানাকে লাভজনক করতে পারেনি। ১৮৮৪ সালে এমেটঅ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি কারখানাটি বিক্রি করে দেন বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপত সিংহের কাছে।
১৯০৬ সালে তার মৃত্যু হলে তার বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্র এবং আরও কিছু ব্যক্তি কারখানাটি কিনে নেন। তারা কারখানাটির নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনির কারবার’। নতুন ব্যবস্থাপনায় ব্রিটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ এনে নিয়োগ করা হয় কারখানাতে। প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত কারখানাটি ভালোই চলে। কিন্তু যুদ্ধের সময় বাইরের দেশে চিনি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যার দরুন কারখানাটি লোকসান দিতে থাকে। তাই ১৯১৫ সালে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আর কোনোদিন কারখানাটি উৎপাদনের মুখ দেখেনি।
তাহিরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর একটি বড় বাজার বসেছিল সেখানে। স্থাপিত হয়েছিল চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহিরপুরের পাশে হাকিমপুর পর্যন্ত সড়কও নির্মাণ হয়েছিল। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসাবে গড়ে উঠেছিল তাহিরপুর। সম্প্রতি তাহিরপুর গেলে দেখা যায়, সেখানে এখন চাষ হয়। কারখানার ধ্বংসাবশেষ বলতে আছে মাটিতে পোঁতা কিছু পাইপ, শাণ বাঁধানো চাতাল। পাশেই কপোতাক্ষ নদীতে যেখানে জাহাজ বাঁধা হতো, সেখানে নদী তীরে একটি স্তম্ভ আছে। স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরা কারখানা ভবন দেখেছেন। তারা স্মৃতিচারণ করে অনেক ঘটনা বর্ণনা করেন। নদীতে একটি জাহাজ নিমজ্জিত হয়েছিল। বহু চেষ্টা করেও কপোতাক্ষ থেকে তা তুলতে পারেনি ইংরেজরা। আজ থেকে ২৫/২৬ বছর আগে পর্যন্তও তার কাঠামো নদীতে পড়েছিল। শুষ্ক মৌসুমে তা দেখা যেত। এখন তা উধাও। কারখানা এলাকা ঢেকে গেছে জঙ্গলে।
১৭৯৪ সালের যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট মি. আর্থার হ্যাসেলারিজ কপোতাক্ষ নদীতে তাহিরপুরের উপরে বাঁধ দেন। উদ্দেশ্য ছিল কপোতাক্ষ নদের স্রোত প্রবাহ ভৈরব নদীতে প্রবাহিত করে তাকে আরও নাব্য করা। কিন্তু পরবর্তীতে বর্ষা মৌসুমে ওই বাঁধ ভেঙে প্রবল স্রোত আবার কপোতাক্ষের খাত দিয়েই প্রবাহিত হতে থাকে। তাহিরপুর আজও মি. আর্থার হ্যাসেলারিজের দেওয়া বাঁধ অতীতের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাহিরপুরের মানুষ অতীতের গৌরবময় ইতিহাসের কথা মনে করে গর্ববোধ করেন এ কারণে যে, এই উপমহাদেশের যান্ত্রিক উপায়ে চিনি তৈরির প্রথম কারখানাটি স্থাপিত হয়েছিল তাদের গ্রামেই। তবে তাদের দুঃখ এ কারণে যে এই গাঁয়ের ইতিহাস কেউ জানে না। গ্রামবাসীদের দাবি এখনো চিনি কারখানার বেশকিছু ধাবত মাটির নিচে রয়ে গেছে। এগুলো মাটি থেকে উত্তোলন করে স্মারক চিহ্ন হিসাবে জাতীয় জাদুঘরে রাখা হোক। ওই স্মারক চিহ্নের সঙ্গে লেখা থাক তাহিরপুরের চিনি কারখানার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সাজেদ রহমান, যশোর।
শীত এলেই বাড়ে কদর
শীতের শুরুতেই প্রতি বছরের মতো এবারও মানিকগঞ্জের ৭টি উপজেলার গাছিরা আগাম খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খেজুরগাছ কাটার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে গাছিদের মধ্যে। হাল্কা কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় চলছে শীতের আমেজ। রস আহরণের জন্য গাছিরা এখন থেকেই গাছের অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ঝেড়ে ফেলার পরে গাছের বুকচিরে সাদা ছাল বের করার কাজ ইতোমধ্যে সেরে ফেলা হয়েছে। মানিকগঞ্জে প্রায় ১৪০০ মানুষ রস সংগ্রহে জড়িত বলে জানা গেছে।
বছরজুড়ে অযতেœ পড়ে থাকা খেজুরগাছগুলোর শীতকালে গাছের চাহিদা ও যতœ বেড়ে যায়। কারণ, গাছ থেকে আহরিত হয় সুমধুর রস। রস জ্বাল করে পাটালিগুড়, ঝোলাগুড়, দানাগুড়সহ বিভিন্ন ধরনের গুড় তৈরি করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করা হয়ে থাকে। খেজুর রসের তৈরি পাটালিগুড়ের ঘ্রাণে এলাকা ম ম করে। তবে যত বেশি ঠান্ডা পড়বে তত বেশি খেজুরের রস উৎপাদন হবে। পুরো মৌসুম চলবে রস আহরণ। গাছিরা রস আহরণ করে বাড়িতে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করে থাকেন। আর কয়েকদিন পরে নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ধীরে ধীরে আমোদিত হয়ে উঠবে গ্রাম-বাংলা। তবে সবেমাত্র শুরু হয়েছে রস সংগ্রহের কাজ।
নালী ইউনিয়নের বাটইমুরী গ্রামের গাছি শাহজাহান মিয়া (৭২) আব্দুল জব্বার মিয়া (৫৬) জানান, তার বাবা প্রয়াত সিদ্দিক আলী গাছ কাটতেন। তার কাছ থেকেই মূলত খেজুরগাছ কাটা শিখেছেন তিনি। প্রায় ৩২ বছর যাবত তিনি খেজুরগাছ কেটে গুড় তৈরি করেন। কিন্তু বর্তমানে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এ পেশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ১৫টি গাছ ঝুড়েছেন। প্রতিদিন ৬ কেজি পর্যন্ত গুড় তৈরি করেন। বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তিনি সরবরাহ করতে পারেন না।
উপজেলার ঘিওর গোলাপনগর গ্রামের মো. সফিজ উদ্দিন (৬৫) বছর। প্রায় ৪২ বছর যাবত খেজুরগাছ ঝোড়ার কাজ করেন। তার বাবা মৃত শহিমুদ্দিন এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। মূলত পৈত্রিক সূত্রে রস সংগ্রহের কাজ করেন। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি ১৮/২০ বছর বয়স থেকে খেজুরগাছ ঝোড়ার কাজ করেন। প্রথমে তার বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। বাবার কাছ থেকেই তিনি কাজটি শিখেছেন। তার বাবা মারা যাবার পরে এলাকার গাছি হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। চলতি বছরে তিন মাসের জন্য সফিজ উদ্দীন প্রায় ২০টি খেজুরগাছ অগ্রিম টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। এছাড়া ভাগে আছে আরও ২০/২৫টি খেজুরগাছ।
গত বুধবার থেকে গাছের অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ও লতাপাতা ঝেড়ে ফেলার পরে গাছের বুকচিরে সাদা ছাল বের করার কাজ ইতোমধ্যেই শেষ করেছেন। আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোদমে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। তিন মাসের রস বিক্রির টাকা দিয়ে তাকে ৬টি মাস চলতে হয়। বাকি ৬ মাস কৃষি কাজ করতে হয়। স্ত্রীসহ ৬ সদস্য নিয়ে মাত্র ৮ শতাংশ জমির ওপরে তার বসবাস। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ পর্যন্ত তার ভাগ্যে একটি বয়স্ক ভাতা জোটেনি। জোটেনি একটি ভিজিডি কিংবা ভিজিএফ কার্ড। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেছে। পরিকল্পিতভাবে খেজুরগাছের আবাদ করা প্রয়োজন।
শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়নের ফরিদ জানান, এ বছর প্রায় ৩০টি গাছ রস সংগ্রহের জন্য তৈরি করছেন। কিন্তু আগামী সপ্তাহ থেকেই খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। যারা খেজুর রসের পাগল তারা শহর থেকে গ্রামে ছুটে আসবে। এই সময়ে রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণ ভরে উঠবে আনন্দে। যদিও আগের মতো সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। তবে মানিকগঞ্জের ৭টি উপজেলাতে কমবেশি খেজুরের গাছ রয়েছে। সারা বছর অযতœ অবহেলায় পড়ে থাকে। শীতের সময় এদের কদর বেড়ে যায়। তবে এ মৌসুমে চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। এ কারণে রাত জগে পাহারা দিতে হয় গাছিদের। রস জ্বাল দেওয়ার পড়ে গুড় তৈরি করে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি খাঁটি গুড় ৪৫০ টাকা থেকে ৬’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়ে থাকে।
জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার হাজারিগুড় দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এছাড়া দৌলতপুর, শিবালয়, সাটুরিয়া, সিংগাইরে প্রচুর পরিমাণে খেজুরগুড় তৈরি হয়। তবে এ সময়ে এক শ্রেণির অসাধু গুড় ব্যবসায়ী চিনি, রং এবং মোকামি গুড় দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে বিভিন্ন উপকরণের সাহায়্যে খেজুরগুড় তৈরি করে হাট-বাজারে বিক্রি করেন।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ (খামারবাড়ি) জানান, সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে খেজুরগাছ রোপণ করা দরকার। তাহলে শীত মৌসুমে খেজুর রস অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে। সরকারি উদ্যোগে বেশি করে খেজুরগাছ রোপণ করতে বন বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া দরকার। খেজুরগুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে অধিক পরিমাণে খেজুর গাছের চারা রোপণ করা প্রয়োজন।
রামপ্রসাদ সরকার দীপু, ঘিওর, মানিকগঞ্জ।