ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

উন্নয়নের ছোঁয়ায় পাল্টেছে জীবনচিত্র

পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহল এখন বদলে যাওয়া জনপদ

ফজলুর রহমান, পঞ্চগড় থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১২ জুলাই ২০২৩

পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহল এখন বদলে যাওয়া জনপদ

পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত গাড়াতী ছিটমহলের পাকা সড়ক

ঘরে ঘরে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি, এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাগুলোও এখন পাকা। তৈরি করা হয়েছে মসজিদ-মন্দির, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, ডিজিটাল সার্ভিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যানিটারি ল্যাট্রিনসহ নলকূপ। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে করে দেওয়া হয়েছে সেমিপাকা ঘর। নির্মাণ করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাকা রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানের দিকে দল বেঁধে ছুটছে শিশুরা। 
এমন চিত্র পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনা অবসানের মাত্র আট বছরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের জীবনচিত্র। উন্নয়নের ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে এই জনপদ। এই জেলার বেশ কয়েকটি বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিনিময় হয় ছিটমহল। এরপর বিলুপ্ত ছিটমহলসমূহে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। ফলে বাংলাদেশী ভূখ-ে যোগ হয় ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি। অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি ঘটে লাখো মানুষের। এর মধ্যে পঞ্চগড়ের ৩৬টি ছিটমহলের ১১ হাজার ৯৩২.৭৮ একর জমিতে মোট ১৯ হাজার ২৪৩ জন বাসিন্দারও মুক্তি মেলে। 
বর্তমান সরকার বিলুপ্ত এসব ছিটমহলের বাসিন্দাদের উন্নয়নে নানা প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নেয়। সে সব উন্নয়নমূলক কাজের ফলে এখানকার অবহেলিত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে রক্তপাতহীন ছিটমহল এসেছে, তাই আত্মপরিচয়ের গর্বে তারা আজ গর্বিত।  
সাতচল্লিশের দেশভাগের বছর হিরা মিয়ার জন্ম। বেড়ে উঠেছেন ছিটমহলে। দেশহীন, নাগরিকত্বহীন জীবন থেকে মুক্তি পেতে সংগ্রাম করেছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ মুক্ত হয়েছে। তার মতো ছিটমহলবাসীর মুক্তি মেলেনি। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালে কাক্সিক্ষত মুক্তি যখন মিলল, তত দিনে কেটে গেছে অবরুদ্ধ জীবনের ৭৫ বছর। 
পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলা থেকে চার কিলোমিটার পূর্ব দিকে এগুলেই বিলুপ্ত ছিটমহল কোটভাজনীর হাটে হিরা মিয়ার পৈত্রিক বাড়ি। গত শনিবার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে কথা হয়। কী পেয়েছেন জানতে চাইলে বললেন, রাস্তা পাইছি, ব্রিজ পাইছি, স্কুল হইছে, হাসপাতাল হইছে। হামরা খুউব সুখে আছি। এহন ভোট দেওয়ার পারি।   
পঞ্চগড়ের আরেকটি বিলুপ্ত ছিটমহল ‘গাড়াতী’। বর্তমানে এই ছিটমহলটি রাজমহল গ্রাম নামে পরিচিত। এটি পড়েছে পঞ্চগড় সদর উপজেলায়। রাজমহল বাজার পার হলেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে নির্মিত গাড়াতী-সংবলিত মানচিত্র ও সাম্প্রতিক উন্নয়নের তথ্যফলক। সেখান থেকে ডান দিকে আরেকটি বাজার। রাজমহল ঘুরে দেখা গেল, অনেক ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের সময় এসব ঘরের বেড়া ও ছাউনি ছিল টিনের। এখন কিছুদূর পর পর আধা পাকা ঘর চোখে পড়ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে ডিজিটাল ট্রেনিং সেন্টার। 
গাড়াতি ছিটমহলের মফিজার রহমান কলেজের শিক্ষার্থী নোলক জানান, ছিটমহলে স্কুল-কলেজ হয়েছে, রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ আসছে আমরা নাগরিকত্ব পেয়েছি। সব মিলিয়ে আমরা দারুণ খুশি। আগে অনেক কষ্টে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লেখাপড়া করতে হতো। শিখা রানী নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি সরকার থেকে সাইকেল পেয়েছি। এখন সাইকেলে করে স্কুলে যেতে পারছি। 
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, সরকার কথা রেখেছে। দীর্ঘ বন্দিজীবন থেকে মুক্ত করে নতুন করে বাঁচার সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা আধুনিক এসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। 
উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে দেবীগঞ্জ উপজেলার দহলা খাগড়াবাড়ি ছিটমহলও। এই এলাকার ঘরে ঘরেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। এলাকার রাস্তা ধরে সহজে কৃষিপণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। রাতবিরাতে কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত কমিউনিটি ক্লিনিকে নেওয়া যায়।    
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম শুরু হয় এবং ফাইনাল খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলার সাবেক ছিটমহলসমূহে ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি মহাবিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এলজিইডি কর্তৃক ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২ কিমি পাকা রাস্তা, ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ব্রিজ-কালভার্ট এবং ১১টি মসজিদ, ৪টি মন্দির, ৫টি বাজার, ১টি কবরস্থান এবং ২টি নদীর ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে। 
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃক ২৩৮ কিমি বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং ৮০০০ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে এবং ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাউলাগঞ্জে ১টি সাব-স্টেশন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এ জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে মোট ৩৪৯টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। 
তবে এসব বিলুপ্ত ছিটমহলের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী, দিনমজুর। জেলা শহর ও ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরিও করছেন কিছু সংখ্যক। ব্যবসা-বাণিজ্যও করছেন কেউ কেউ। এখানকার অন্তত ২০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। 
লিলি বেগম তার দুই বছরের শিশুকন্যার জন্য একটি প্রকল্প থেকে ভাতা পাচ্ছেন। লিলির সঙ্গে কথা বলার সময় ছিলেন তার প্রতিবেশী মোবাশ্বের ও রফিক ম-ল। মোবাশ্বের বয়স্ক ভাতা ও রফিক প্রতিবন্ধী ভাতা পান বলে জানান। তারা বলছেন, ‘আমাদের জীবনে কিছু করার আর সুযোগ নেই। তরুণ বয়সে বাংলাদেশী হয়েও ভারতের অধীনে ছিলাম। পড়ালেখা করতে পারিনি, কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। আমাদের সন্তানরা বাংলাদেশের নাগরিক। পড়ালেখা শেষ করে সরকারি চাকরি পাবে, সেই আশায় স্বপ্ন বুনছি।’ 
জানতে চাইলে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলের বাসিন্দাদের পরিচয় ছিল না, তারা কোন দেশের। প্রধানমন্ত্রীর কারণে রক্তপাতহীন পরিচয় এসেছে তাদের। সরকারের নানামুখী প্রকল্প ও উন্নয়মূলক কর্মকা-ের ফলে বিলুপ্ত ছিটমহলে ব্যাপকহারে উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েছে। তারা সেসব এখন ভোগ করছেন, এটাই আত্মতৃপ্তির। পিছিয়ে পড়া বিলুপ্ত ছিটমহল বাসিন্দাদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরও কাজ করা হচ্ছে।  
আগামী ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের ৮ বছর পূর্ণ হবে। ছিটমহল বিনিময় দিবস উদ্যাপন করবেন এখানকার বাসিন্দারা, সেই অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। এমনটিই জানিয়েছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা।

×