
বগুড়ার রেলগেটের কাছে কোরবানির জন্য তৈরি করা চাকু, ছুরি, দা বিক্রি
ভীতিকর। তবে কোরবানির ঈদের দিনের প্রয়োজনীয়। ঈদুল আজহার নামাজ শেষে সকলের একটাই ব্যস্ততা। কোরবানির পশু গরু ছাগল জবাই ও কাটা ছেলা। এ জন্য দরকার ছুরি, ছোট বড় চাকু, ছোট বড় দা বঁটি ইত্যাদি। হালে অনেক ছুরি দেখতে মাঝারি তরবারির মতো। এগুলো হলেই তো হবে না। ধারও থাকতে হবে। বেশি ধার না থাকলে গরু জবাই ঠিকমতো হবে না। জবাই ঠিকমতো না হলে গরু গলাকাটা মাথা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটে।
বগুড়া শহরের রেলগেটের কাছে ছুরি দা বঁটি চাকুর পসরা বসিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যাদের অনেকেই মৌসুমি ব্যবসায়ী। ঈদের কয়েকদিন আগে তারা কামার বাড়ি থেকে ছুরি দা চাকু বঁটি বানিয়ে বিক্রি করেন। এদের একজন সামসু। তিনি কামারের কাজ করেন। ঈদের সময়টায় ছুরি দা চাকু বেচেন। লোহার দাম বেশি হওয়ায় এবারের ছুরি চাকু দায়ের দাম বেশি। ছোট বড় মাঝারি ভেদে দাম চারশ’ টাকা থেকে বারোশ’ টাকা। নতুন চাকু ধার দিতে হয় না। শহরের লোকজন একবার কিনলে তা দিয়েই পরবর্তী বছরের কোরবানি সামাল দেন। এ সময় অনেক কসাই নতুন চাকু দা কেনে।
কোরবানির ঈদে এই গরু খাসি ছাগল জবাইর জন্য দরকার মুনসি মৌলবির। নামাজের পর দেখা যায়, শহরের প্রতি বাড়ির সামনে মালিক ও সদস্য ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে মৌলবি খোঁজেন। কোনোভাবে একজন মৌলবির দেখা পেলে তিনি কয়েক বাড়ির গরু কোরবানি করে দেন। গৃহকর্তারাও ছুরি শান দিয়ে রাখেন। কোরবানির ঈদের ছুরি চাকু দা না হলেই নয়। গরু কাটা-ছেলার জন্য কসাই ভাড়া করতে হয়। তাদেরও দরকার ছুরি চাকু।
রাজবাড়ীতে ব্যস্ত কামাররা
নিজস্ব সংবাদদাতা রাজবাড়ী থেকে জানান, ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র ক’দিন। তবে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামার শিল্পীরা। সারাবছর অলস সময় কাটলেও এখন যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই তাদের। ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক মাস আগে থেকে ছুরি-চাকু-বঁটি, চাপাতি, দা তৈরি এবং পুরাতনগুলো শান দেওয়ার কাজে ব্যস্ত কামার শিল্পীরা। হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে রাতদিন মুখর থাকে কামার পাড়া। রবিবার সকালে জেলার বিভিন্ন এলাকার কামার পাড়া গিয়ে দেখা যায়, টুং টাং শব্দ। কেউ কয়লা পুড়িয়ে লোহা লাল করছে, কেউ আবার লাল করা লোহা পিটানোয় ব্যস্ত রয়েছে। এ সময় কথা হয় রবি বিশ্বাস (৬০) কামারের সঙ্গে। তিনি জানান, সারাবছর কোনো কাজের চাপ থাকে না। বসে বসে অলস সময় কাটাতে হয়। যা কাজ করি সেটা দিয়ে কোনো রকম জীবন যাপন করতে হয়। তবে দুই ঈদ।
বিশেষ করে কোরবানি ঈদে আমাদের কাজের চাপ বেড়ে যায়। ১১ মাস বসে থাকলেও একটি মাস যেন দম ফেলানোর সময় পাই না। তিনি দুঃখ করে আরও বলেন, সারাবছর বসে থেকে এক মাস কাজ করলে কি সংসার চালানো যায়। তাই অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। এ সময় ফটিক কর্মকার নামের এক ব্যক্তি বলেন, এখন অনেক ব্যস্ত। এমন কাজ সারা বছর থাকলে আমরা আরও অনেক ভালো জীবন যাপন কাটাতে পারতাম। কিন্ত দেখা যায়, সারাবছর কোনো রকম বেঁচে থাকি। তবে এই মাসে আমাদের অনেক কাজ।
টাঙ্গাইলে দম ফেলার সময় নেই
নিজস্ব সংবাদদাতা টাঙ্গাইল থেকে জানান, আর মাত্র কয়েকদিন পরেই মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলে কোরবানির পশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য উপকরণ দা-ছুরি-চাপাতি কিনতে কামারের দোকানেও বাড়ছে ভিড়। আর এ সব উপকরণ তৈরি করতে নাওয়া খাওয়া ভুলে নির্ঘুম রাত কাটছে কামার শিল্পীদের। তবে কয়লার দাম বেশি হওয়ায় অন্যবারের চেয়ে এবারে দা-বঁটি, ছুরি ও চাপাতির দাম কিছুটা বেশি বলেও জানা গেছে।
ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে কামারদের ব্যস্ততা। সামনে আগুনের শিখায়-তাপ দেয়া, হাতুড়ি পেটানোর টুং-টাং শব্দে তৈরি হচ্ছে দা-বঁটি, চাপাতি ও ছুরি। পশু কোরবানিতে এসব অতীব প্রয়োজনীয়। নতুন তৈরির সঙ্গে শহর ও গ্রাম-গঞ্জে সব জায়গায় কামাররা ব্যস্ত পুরনো দা-বঁটি, ছুরি ও চাপাতিতে শান দিতে। আবার মোটরচালিত মেশিনে শান দেয়ার কাজও চলছে। তাই যেন দম ফেলারও সময় নেই কামারদের।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন কামারপল্লীতে ঘুরে দেখা যায়, কোরবানিদাতারা কোরবানির পশু কাটাছেঁড়া করার জন্যে পরিবারের ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত দা-বঁটি ও ছুরি শান দেওয়ার জন্য নিয়ে আসছে কামারদের কাছে। এর ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কামারদের বিরামহীন ব্যস্ততা। অন্য সময়ের চেয়ে দোকানে মৌসুমি কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা গ্রামের শান্ত কর্মকার জানান, সাধারণত স্প্রিং লোহা ও কাঁচা লোহা ব্যবহার করে দা-বঁটি ও ছুরি তৈরি করা হয়। স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণের মান ভালো, দামও বেশি। আর কাঁচা লোহার তৈরি উপকরণগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম।
আমতলীর দুই বিধবা কামারের যুদ্ধ
নিজস্ব সংবাদদাতা আমতলী বরগুনা থেকে জানান, দুই ভাই মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর স্বামীর ঐহিত্য ধরে রাখতে সাহসী সংগ্রামী দুই বিধবা নারী কামার জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরুষরা হিমশিম খেলেও তারা ওই কাজে বীরযোদ্ধা। জীবনযুদ্ধে তারা আমতলীতে অদ্বিতীয়। তাদের দাবি সরকারের সহযোগিতা পেলে তারা আরও এগিয়ে যেতে পারতেন। ঘটনা আমতলী পৌর শহরের সদর রোডে।
জানা গেছে, আমতলী পৌর শহরের সদর রোডের শ্যাম কর্মকারের দুই ছেলে আশীষ কর্মকার ও অসীম কর্মকার। দুই ছেলেকে নিয়ে শ্যাম কর্মকারের কামার শিল্প বেশ জমজমাট ছিল। গত ৬০ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত তিনি। ২০১০ সালে শ্যাম কর্মকারের বড় ছেলে আশীষ কর্মকার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। দুই বছর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১২ সালে মারা যান। বিধবা হয়ে পড়েন তার স্ত্রী ঝুমা কর্মকার। স্বামীর ঐহিত্য ধরে রাখতে বৃদ্ধ শ^শুর ও দেবর অসীম কর্মকারের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ লোহার কাজে সহযোগিতা করেন বিধবা ঝুমা। কিছুদিন পরই ফুসফুস ক্যান্সারের আক্রান্ত হন ছোট ছেলে অসীম কর্মকার।
৫ বছর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১৯ সালে ৫ নভেম্বর তিনিও মারা যান। বিধবা হয় স্ত্রী পুতুল রানী কর্মকার। দুই ছেলেকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বৃদ্ধ বাবা শ্যাম কর্মকার (৮২)। দুই ছেলেদের চিকিৎসায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেন তিনি। মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় তারা কোনোমতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তাদের কামার শিল্প। এমন মুহূর্তে দুই ছেলের দুই বিধবা স্ত্রী ঝুমা রানী কর্মকার ও পুতুল রানী কর্মকার স্বামীর ঐহিত্য ধরে রাখতে কামার শিল্পের হাল ধরেন। দিন রাত অদম্য পরিশ্রম করে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কর্মযজ্ঞ। যুদ্ধ করেন আগুন ও লোহার সঙ্গে। প্রতিদিন দা, বঁটি, কুঠার, হাতুড়ি, ছেনা, চাকু ও খুন্তিসহ লোহার জিনিসপত্র তৈরি করেন। আগুন এবং লোহার সঙ্গে দুই বিধবা নারী গড়ে তোলের গভীর মিতালি।
হোসেনপুরে নির্ঘুম রাত
নিজস্ব সংবাদদাতা হোসেনপুর কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, হোসেনপুরে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে কামারদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই এক রকম নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আড়াইবাড়িয়া ও ধনকুড়া কামারপল্লীতে কোরবানির পশু জবাই ও হাড় কাটার প্রয়োজনীয় উপকরণ দা-ছুরি, চাপাতি, চাকু ও বঁটি তৈরিতে দিন-রাত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাই রুজি-রোজগারও ভাল হচ্ছে বলে জানালেন স্থানীয় কামাররা।
স্থানীয় কর্মকার খোকন মিয়াসহ অনেকেই জানান, দা-ছুরি ও চাপাতির কদর বেশি থাকায় তারা রাত দিন কাজ করেও ক্রেতাদের চাহিদা মিটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দাম প্রসঙ্গে বলেন, কয়লার দাম বাড়ার কারণে দা, বঁটি, চাপাতিসহ অন্যান্য পশু কোরবানির সরঞ্জামের দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের আর উপায় নেই।