ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

লালমনিরহাট-২

আওয়ামী লীগের আসনে ভাগ বসাতে মরিয়া জাতীয় পার্টি

তাহমিন হক ববী, লালমনিরহাট থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২৫ জুন ২০২৩

আওয়ামী লীগের আসনে ভাগ বসাতে মরিয়া জাতীয় পার্টি

তুষভাণ্ডার জমিদার কালীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর নামে কালীগঞ্জ উপজেলা

তুষভাণ্ডার জমিদার কালীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর নামে কালীগঞ্জ উপজেলা ও ধরলা, তিস্তা ও স্বর্ণামতি নদী এবং নামুরীর বিল ঘেরা স্মৃতিবিজড়িত আদিতমারী উপজেলা। এই দুইটি উপজেলায় ৮টি করে ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত লালমনিরহাট-২ জাতীয় সংসদের ১৭তম আসন। এ আসনটি লালমনিরহাট জেলার মধ্যবর্তী স্থান।
আসনটির টানা দুইবারের সংসদ সদস্য বর্তমান সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তিস্তা নদীর ভাঙন ঠেকাতে মন্ত্রী নুরুজ্জামান কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে  ৪৯ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে  বাঁধের নির্মাণ কাজ চলমান। এলাকার সচেতন মহল বলছেন, এখানে আওয়ামী লীগের হাতে থাকা আসনটিতে বিএনপি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবার এই আসনে বিএনপির প্রার্থী চমক দেখা পারে। আবার ঝিমিয়ে পড়া  জাতীয় পার্টি নতুনভাবে জেগে উঠছে। তারাও আসনটি দখলে মরিয়া।   
আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ১ হাজার ৩৮৮। এর মধ্যে পুরুষ দুইলাখ ১ হাজার ৩৫৩,  নারী ২ লাখ ৩৪ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের একজন।
বিগত ১১টি নির্বাচনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি রংপুর-১৭ নামে পরিচিত ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সামশুল হোসেন সরকার বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ন্যাপ মোজাফফরের গাউসুল আজম। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি পরিচিতি হয় রংপুর-৬ নামে। নির্বাচনে বিএনপির মজিবর রহমান বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের করিমুদ্দিন আহমেদ। ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৬ আসনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লালমনিরহাট-২।

নির্বাচনে বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে লাঙ্গল মার্কা নিয়ে মজিবর রহমান বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে  জাতীয় পার্টির  মজিবর রহমান বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহ আলম আলবানি। 
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে পুনরায় জাতীয় পার্টির মজিবর রহমান বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের সামশুল ইসলাম। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিজয়ী হয়। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফ্রিডম পার্টির আব্দুল মান্নান সরকার। এই সংসদ ১১ দিনের ছিল। 
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মজিবর রহমান বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের নুরুজ্জামান আহমেদ। ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মজিবর রহমান বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুজ্জামান আহমেদ। 
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ  নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মজিবর রহমান ফের বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির সালাউদ্দিন আহমেদ হেলাল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের নুরুজ্জামান আহমেদ বিজয়ী হন।  ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের নুরুজ্জামান আহমেদ বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির রোকন উদ্দিন বাবুল।  
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, লালমনিরহাট-২ আসনে প্রথম, দশম, একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় এবং ১১ দিন মেয়াদের ৬ষ্ঠ সংসদে বিএনপি, তৃতীয়,  চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম নবম সংসদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। 
বলা যেতে পারে, দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজত্ব ছিল এই আসনে। এখান থেকে প্রথমে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হওয়া মজিবুর রহমান পরে যোগ দেন জাপায়। জাপার টিকিটেই ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া)। তবে সেই  জৌলুস হারিয়েছে জাতীয় পার্টি। বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কমবেশি কোন্দল ¯পষ্ট। নেতৃত্ব নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রকাশ্যে এলাকাবাসী দেখছে। তবে ভেতরে-ভেতরে জামায়াতে ইসলামীও ভোটের জন্য সুসংগঠিত হচ্ছে।
২০১৪ সালে আসনটি  আওয়ামী লীগের কাছে চলে আসে।

এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি নুরুজ্জামান আহমেদ। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন। তিনি আবারও এই আসনে নৌকার মাঝি হবেন এমনটাই প্রত্যাশা তার সমর্থক নেতাকর্মীদের। 
আগামী নির্বাচনে নুরুজ্জামান আহমেদের পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. সিরাজুল হক ও ১৯৯৬ সালের নৌকার সাবেক প্রার্থী এমদাদুল হকও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে এই আসনে এবার বিএনপি ও জাতীয় পার্টি শক্ত প্রার্থী দিতে যাচ্ছে। তাই এই আসনে বর্তমান এমপিকেই নেতাকর্মীরা ভোট যুদ্ধে শক্ত প্রার্থী হিসাবেই মনে করছেন। 
আসনটিতে টানা ছয়বার জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি মজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। নেতৃত্বশূন্য আসনটি জাতীয় পার্টি ফের গুছিয়ে তুলতে মাঠে নেমেছে। তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই আসনে জাপার সাবেক এমপি মরহুম মজিবুর রহমানের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম কামাল মতবিনিময় করে যাচ্ছেন। 
দলটির জেলা পর্যায়ের এক শীর্ষ নেতা জানান, লালমনিরহাট-২ আসনে অন্য দলের আরও দুইজন জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে পারেন। তাদের নাম উল্লেখ না করে ওই নেতা বলেন, তারা মনোনয়ন পেলে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করবেন এমন কথা নির্বাচনী এলাকায় চাউর হয়েছে। এ ছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শাহ সুলতান নাসিরুদ্দিন আহম্মেদ মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন। 
এদিকে, এই আসনে জেলা বিএনপির সহসভাপতি রোকন উদ্দিন বাবুল এবং তার চাচাত ভাই কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক এমপি (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির জেলা উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহম্মেদ হেলাল, জিয়া পরিষদ রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক স¤পাদক ড. রোকনুজ্জামান মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে। 
তবে এই আসনে বিএনপি চমক দেখাতে পারে বলে কথা উঠেছে। এই চমকে রয়েছে তা হলো বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ২ ও ৩ আসনে বিএনপির জেলা সভাপতি ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু প্রার্থী হবেন। জেলা জুড়ে এমন কথা চাউর হলেও বিএনপির পক্ষে কোনো বক্তব্য দেখা হয়নি। 
অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী এখানে ভেতরে-ভেতরে তারা অনেকটাই সুসংগঠিত। দলটি এখানে তাদের প্রার্থী দিবে এমনটা বলা হলেও তারা প্রার্থীর নাম এখনো সামনে আনছেন না। এই আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসাবে দলটির জেলা সভাপতি আলহাজ মো. ইব্রাহিম হোসেন খান অথবা সহ-সভাপতি মুফতি মাহফজুর রহমান মনোনয়ন পেতে পারেন।

×