
বগুড়া-৬ (সদর) আসনটি খুবই জটিল
বগুড়া-৬ (সদর) আসনটি খুবই জটিল। আগে আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলে কথিত ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এ বছর উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু বিজয়ী হওয়ার পর তার চার মাসের উন্নয়ন কর্মকা-ে বগুড়ার মানুষ পাল্টে গেছে। দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের আগে হাতে আরও কিছুটা সময় আছে। সেই হিসাব কষেই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর হৃদয় স্পর্শ করছেন।
রোমান কথায় ‘ভিনিভিডিভিসির (এলাম দেখলাম জয় করলাম)’ মতো। বগুড়ার সাধারণের মধ্যে বলাবলি হয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা যদি রিপুকে নির্বাচিত করত তাহলে উন্নয়নের ধারায় বগুড়া আরও এগিয়ে থাকত। রাগেবুল আহসান রিপু নির্বাচিত হওয়ার পর বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। বগুড়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন যা আটকে ছিল তার পথ সুগম হয়েছে।
বগুড়ার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের ফতেহ আলী (র) ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার বগুড়া সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে নিজস্ব কেন্দ্রে রূপান্তর হচ্ছে। শহীদ চান্দু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম পুনরায় চালু হয়েছে। নতুন শহীদ মিনার নির্মিত হচ্ছে। শেখ কামাল আইটি ইনক্যুবেশন সেন্টার, নরুলের বিলে ৪৫০ বিঘা জায়গায় হাইটেক পার্ক, যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার, ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনে অনলাইন টিকিট ও আসন বৃদ্ধি, প্রত্ন সম্পদ মাউন্ট (ঢিবি) সংরক্ষণসহ বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। নানা কর্মকাণ্ডে বর্তমান সংসদ সদস্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সব সময় সাধারণের কাছে গিয়ে পরামর্শ চান আরও কি করা যায়। এই অগ্রযাত্রায় বগুড়া-৬ (সদর) আসনের মানুষ তাকেই পছন্দ করছে। লোকমুখে এমনই বলাবলি হয়।
বিএনপির সমর্থকরা অবশ্য বলছেন, দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে কঠিন প্রতিযোগিতা হবে। আরেক পক্ষের কথা : বিএনপির অংশ নেওয়া এর আগের নির্বাচনে বগুড়ার কোনো প্রার্থী ছিল না। বাইরে থেকে ‘হায়ার’ করে আনতে হয়েছে জমির উদ্দিন সরকারকে। গত একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনিও ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ। বিজয়ী হয়ে পরে তিনি বগুড়ার আসন ছেড়ে দেন।
দ্বিতীয় দফার উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হন বিগত নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী ধুনট-শেরপুর আসনের গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। গতবছর তিনিও পদত্যাগ করলে আসনটি শূন্য হয়। উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাগেবুল আহসান রিপু। তার কর্মকা- বগুড়ার মানুষকে কাছে টেনেছে। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। নির্বাচিত হলে বগুড়ার উন্নয়নে সংসদে ও বাইরে জোড়ালো ভূমিকা রাখবেন।
বগুড়ার এই আসনে ইতোপূর্বে দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের প্রার্থী আসন পায়। অবশ্য এর ব্যত্যয় ঘটেছে। তবে খুব কম।
দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের পর পটপরিবর্তন ঘটে। নানা ঘটনা প্রবাহে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রেফারেন্ডামে (হ্যাঁ/না ভোটে) প্রেসিডেন্ট হন। রাজনৈতিক দল গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারপর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীগণ নির্বাচিত হন।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকা-ের পর ক্ষমতার পালাবদলে আসেন আরেক সেনা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ (এইচ এম) এরশাদ। তিনিও একটি দল গঠন করেন জাতীয় পার্র্টি(জাপা)। টানা নয় বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন যে নির্বাচন হয়েছে বিজয়ী হয়েছেন জাপা প্রার্থী। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলে এই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে (তিন মাস স্থায়ী) বিজয়ী বিএনপির প্রার্থী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দেশে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তবে বগুড়ার এই আসনে থাকেন বিএনপি প্রার্থী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে।
বগুড়া সদর আসনে নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। তিনি বগুড়া-৬ আসন ছাড়াও বগুড়া-৭ (গাবতলি) আসনে বিজয়ী হন। পরে এই দুই আসন ছেড়ে দিলে বগুড়া সদরে নির্বাচিত হন বিএনপির জমির উদ্দিন সরকার। (বগুড়া-৭ আসনে নির্বাচিত হন বিএনপির মওদুদ আহমেদ)। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে বগুড়া সদর আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির (জাপা) নুরুল ইসলাম ওমর। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। পরে তিনি এই আসন ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। গতবছর তিনি পদত্যাগ করলে এ বছরের প্রথমে এই আসনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু।
দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী মনোনয়ন চাইবেন। সেই মাঠ তিনি তৈরি করছেন। আলাপচারিতায় বর্তমান সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু বলেন, উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর হাতে সময় পেয়েছেন মাত্র নয় মাস। এই ক’মাসে যতটা সম্ভব উন্নয়নের ধারাকে যতটা এগিয়ে নেওয়া যায় তাই করবেন। এই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে বগুড়ার ভোটাররা অনেক আশাবাদী। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের (যাদের মধ্যে আছে নতুন ভোটার) কাছে রিপু অনেক বড় আসন করে নিতে পারছেন। বয়সে তারুণ্যের উদ্দীপনায় রিপু এগিয়ে চলেছেন।
বর্তমান সংসদ সদস্যরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। তিনি নির্বাচনী মাঠে আছেন। পরখ করছেন আগামীর রাজনীতির দিনগুলো। সম্ভাবনা থাকলে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে দেখা যায়। মনোনয়ন চাইতে পারেন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী কোহিনুর মোহন। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও সমাজসেবায় অংশ নিচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি টি জামান নিকেতা আছেন মনোনয়ন সারিতে। তিনি গত উপ-নির্বাচনে বগুড়া সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও বগুড়া চেম্বারের সভাপতি মাসুদার রহমান মিলন (তিনি জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে) আছেন লাইমলাইটে। আওয়ামী লীগের পক্ষে তিনি জোড়ালো ভূমিকা পালন করছেন। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনিও মাঠে আছেন।
অন্যদিকে, বিএনপি আছে দোদুল্যতার মধ্যে। দ্বাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, এ নিয়ে তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটছে না। বগুড়া সদরের গত উপ-নির্বাচনে ছিলেন বিএনপির গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন ঢাকার হাই কমান্ডের দিকে। তারা কখন কোথায় কি বলছেন কি করছেন তার খোঁজখবর রাখেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতির পর বগুড়ার বিএনপির নেতারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। তারা মুখে বলেন ভিসা নীতিতে বিপাকে পড়বে ক্ষমতাসীন দল। তবে আড়ালে আবডালে বলেন তাদের (বিএনপি) কিছু হবে না তো। একজন বললেন সভা সমাবেশে তারা ছবি তুলে রাখছেন। নির্বাচনের বিষয়ে তাদের কথা- নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নির্ভর করছে হাইকমান্ডের ওপর। এখন পর্যন্ত তারা একটি দাবির মধ্যে আছে- নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আবার এমন কথাও উঠছে নেতারা যদি আলোচনার টেবিলে বসেন তাহলে তারা সিদ্ধান্ত দেবেন। এই ক্ষেত্রে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন ‘লন্ডন’ থেকে যে নির্দেশ আসবে তাই তারা মানবেন (লন্ডন অর্থ তারেক রহমান)।
দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় যাদের নাম শোনা যায় তারা হলেন- জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট মাহাবুবর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আলী আসগর হেনা, এম আর ইসলাম স্বাধীন ও সরকার বাদল। এছাড়াও এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ অংশগ্রহণ করতে পারেন।
তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত কে মনোনয়ন পাবেন এ নিয়ে নেতারা টানাপোড়েনেও আছেন। ইতোপূর্বের অভিজ্ঞতায় তারা দেখেছেন প্রস্তুতি থাকার পরও বহিরাগতরা প্রার্থী হয়েছেন। তবে একটি সূত্র অবশ্য বলছেন, লন্ডন থেকে যে বার্তা আসবে তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা স্থানীয় নেতাদের নেই। জটিল এই আসনের সমীকরণ খুব কঠিন।
জামায়াতের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ১০ জুন ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশের পর তাদের মধ্যে প্রফুল্লতা দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের এক সূত্র জানায়, নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলে বগুড়ার এই আসনে প্রার্থী হবেন শহর আমির আবিদুর রহমান সোহেল।
এই আসনে ছোট দলগুলোও অংশগ্রহণ করে। যেমন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাকের পার্টি, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকে অনেক। জাসদ থেকে প্রার্থী হতে পারেন অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক ইমদাদ। তিনি গত উপ-নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। হালে নির্বাচনী মাঠে ইউটিউবার খ্যাত আশরাফুল হোসেনের (হিরো আলম) নাম আসছে। এ বছর বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হিরো আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে বিজয়ী হতে পারেননি। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর তালিকায় অনেক নাম আসছে। তাদের মধ্যে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সাবেক সভাপতি মাসুদার রহমান হেলাল। তিনি গত উপ-নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন।
বগুড়া সদর আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৭শ’ ৩০ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার বেশি। দ্বাদশ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নতুন ভোটার হয়েছে তরুণদের একটি অংশ। যাদের বাদ দিয়ে হিসাব করা যায় না। একজন প্রার্থী বললেন, বগুড়া সদর আসনে নারী ভোটার ও তরুণ ভোটার নির্ধারণ করবে কে হতে যাচ্ছেন আগামীর সংসদ সদস্য।