ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অবহেলিত বধ্যভূমি

যশোর

সাজেদ রহমান, যশোর

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৩১ মার্চ ২০২৩

যশোর

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোরের নৃশংসতম দিন

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোরের নৃশংসতম দিন। এদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসায় ঢুকে ২৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও বহু মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এর পাশে সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের একটি গর্তে মুক্তিযুদ্ধের পর শত শত মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, ৪ এপ্রিল রেলস্টেশন মাদ্রাসার ভেতর যাঁদের হত্যা করা হয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং তাঁদের স্মরণে স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। তাহলে তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে পারবে নতুন প্রজন্ম।

এদিন যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসায় ও মসজিদে ঢুকে পাকবাহিনী যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল সে কাহিনী চাপা পড়ে আছে। ওই জঘন্যতম হত্যাকা-ের ঘটনায় সেদিন শহীদ হয়েছিলেন ২৩ জন। মসজিদ ও মাদ্রাসা ট্র্যাজেডিতে অনেক পরিবার প্রিয় মানুষকে হারিয়ে আজও কাঁদে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হানাদার বাহিনী স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় সকালে যশোর রেলস্টেশনের দক্ষিণে মাদ্রাসায় প্রবেশ করে। এ সময় অনেকে ইবাদত করছিলেন। পাঠ করছিলেন পবিত্র কুরআন শরীফ।

এই মাদ্রাসাতে স্থানীয় বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছাত্র-শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন। ওইসব শঙ্কিত মানুষ যখন মহান আল্লাহর কাছে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য নিজেদের প্রাণ ভিক্ষার ক্রন্দন করছিলেন, ঠিক তখনই হায়েনারা ছাত্র-শিক্ষক-মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৩ জনকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে ওই ২৩ জনকে এক সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

সেদিন কারা শহীদ হয়েছিলেন তার কোনো তালিকা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। মহান স্বাধীনতার এত বছর পরও এখানে নির্মাণ করা হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। নীরবে পার হয়ে যায় প্রতিবছর ৪ এপ্রিল। শুধু শহীদ পরিবারের দু’একজন তাদের প্রিয় মানুষকে স্মরণ করার জন্য গণকবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। 
রেলস্টেশন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আনোয়ারুল করীম, এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফফার লাল ও কয়েকটি শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৬ জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন: চাঁচড়া ডালমিল এলাকার একই পরিবারের তাহের উদ্দিন (দাদা), যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এবিএম আব্দুল হামিদ (বাবা) ও তার পুত্র বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র এবিএম কামরুজ্জামান।

একই এলাকার যশোর জেলা শিক্ষা অফিসের প্রধান করণিক কাজী আব্দুল গণি ও তার ছেলে কাজী কামরুজ্জামান বিএসসি, খুলনা কমিশনার অফিসের কর্মচারী কাজী দীন মোহাম্মদ, যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক কাজী আইয়ুব হোসেন ও যশোর কালেক্টরেট অফিসের কর্মচারী কাজী আব্দুল কালাম আজাদ, রেলস্টেশন মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর, শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের পিতা যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ, শহর আলীর ছেলে আবু কালাম এবং মাদ্রাসার ছাত্র আতিয়ার রহমান, নোয়াব আলী, লিয়াকত আলী, মাস্টার আব্দুর রফিক ও আক্তার হোসেন। 
সেদিনের সেই নারকীয় তা-বের প্রত্যক্ষদর্শী রেলস্টেশন এলাকার শেখ আব্দুর রহিম। একাত্তরে তার বয়স ছিল ২২/২৩ বছর। তখন তিনি যশোর ইনস্টিটিউটে চাকরি করতেন। মাদ্রাসার পশ্চিমপাশেই তাদের বাড়ি। তিনি জানান, সকাল ৮টার দিকে আমি বুটের আওয়াজ শুনি। দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আর্মি ঢুকছে। আমি এগিয়ে যাই। প্রাচীরের কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি আর্মিরা বড় হুজুরের সঙ্গে কি যেন বলছে। আর্মিদের সঙ্গে আসা বিহারি আবুল, জাপা, মুন্নু-এরা বলে- স্যার, এ হুজুর না। ইপিআর। পাকিস্তানের শত্রু। এ ছদ্মবেশ ধরে মাথায় টুপি নিয়েছে।

এরই মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর এগিয়ে আসেন। তিনি আর্মিদের উদ্দেশে বলেন, ‘মার কাফেরের বাচ্চারা। আমার বুকে গুলি কর।’ সেই সময় আর্মি কাঠি হুজুরকে গুলি করে হত্যা করে। হুজুর মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি  পেছনে দৌড়ে পালিয়ে যাই। পাশেই ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে গিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকি। এ সময় গুলির পর গুলির শব্দ শুনতে পাই। এক পর্যায়ে গুলির শব্দ থেমে যায়। দুপুরের দিকে মাদ্রাসায় যাই। দেখি বারান্দায়, মাঠে শুধু লাশ আর লাশ। পুরো মাঠ রক্তে ভেসে গেছে। কোথাও কেউ নেই। আমি গুনে দেখি ২৩টি লাশ পড়ে আছে।
১৯৭১ সালে ৯ বছরের বদরুজ্জামানের বয়স এখন অনেক। কিন্তু রক্ত দেখলে তিনি আঁৎকে উঠেন। পাকহানাদারদের নৃশংসতার কথা মনে পড়ে যায়। সেই দিনের কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। কেননা, তার সামনেই তার বাবা কাজী আব্দুল গণি, বড় ভাই কামরুজ্জামানকে সেদিন পাকহানাদাররা হত্যা করেছিল।
যশোর শহরের রায়পাড়া এলাকার শিক্ষা অফিসের করণিক আব্দুল গণি তার পরিবার নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। তিনি আর তাঁর বড় ছেলে প্রাণ বাঁচাতে পারেননি। বাবা-ভাইয়ের হত্যার এই নির্মম দৃশ্য ক্লাস ফোরের ছাত্র বদরুজ্জামান প্রত্যক্ষ করেছে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বদরুজ্জামান জানান, হঠাৎই সব ঘটে গেল। বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েও কয়েক ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন। তিনি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারেনি। তাই বাবা মারা যান। ভাই মাঠের মধ্যে লাশ হয়ে পড়ে থাকে।

ভয়ে আমি আর মা পাশের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিই। বদরুজ্জামানরা ছিলেন দুই ভাই। বড় ভাই কামরুজ্জামান বাবার সঙ্গে মাদ্রাসা ট্র্যাজেডিতে শহীদ হন। অনেক সংগ্রাম করে পরিবারটিকে চলতে হচ্ছে। সরকারি চাকরি করেও গণির পরিবার পেনশনের টাকা তুলতে পারেননি। পাননি শহীদ পরিবারের মর্যাদা।
এর পূর্ব পাশে দেশের অন্যতম বধ্যভূমি যশোরের শঙ্করপুর সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। এই বধ্যভূমিতে একাত্তরে বিহারিরা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী এখান থেকে কয়েক ট্রাক হাড়-কঙ্কাল সরিয়ে নিয়ে গেছে। ১৯৯২ সালে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই বধ্যভূমির পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি নির্মাণ করে। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরে বিভিন্ন সংগঠন এই স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের উদ্দেশ্যে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে।

যশোর শহরের দক্ষিণ দিকে শঙ্করপুর এলাকায় এ হাঁস-মুরগির খামারটি আইয়ুব খানের শাসন আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ খামার। এই খামারের বধ্যভূমি সম্পর্কে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বিহারিরা এখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। হাবিব, টেনিয়া, কালুয়া, রমজান, মোস্তফা ছাড়াও শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিহারিরা বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে জবাই করে হত্যা করত। তাদের ভাষ্য, শত শত মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। এই বধ্যভূমি সম্পর্কে আরও জানা গেছে, খামারের ভেতরের মুরগি রাখার ৪ ও ৫ নং শেডে লাশ পুঁতে রাখা হতো। এই শেডের পাশে ছিল পাম্প হাউস।

এখানে বাঙালিদের জবাই করা হতো। খামারের পশ্চিমে ১১নং শেডের পাশে ছিল বিরাট কুয়া। এই কুয়াটি খনন করা হয়েছিল মরা মুরগি ফেলার জন্য। কিন্তু, একাত্তরের বিহারিরা এই কুয়া বাঙালিদের লাশে ভরে ফেলে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধারা এই বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন। ইলা মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী বধ্যভূমি ঘুরে দেখে হতবাক হয়ে যান। তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবি করেন।
সাজেদ রহমান, যশোর

×