ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদিনেই সাড়ে তিন কোটি টাকার কেনাবেচা

গদখালীতে এবার রেকর্ড দামে গোলাপ বিক্রি

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

গদখালীতে এবার রেকর্ড দামে গোলাপ বিক্রি

সোমবার যশোরের গদখালী ফুলের বাজার থেকে ফুল কিনে ভ্যানে তোলা হচ্ছে

যশোরের গদখালী এবার গোলাপের পাইকারি দামে রেকর্ড ভেঙেছে। চাহিদা থাকায় সোমবার রেকর্ড পরিমাণ দামে গোলাপ বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি গোলাপ ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। পাইকারি বাজারে গোলাপের এত দাম এর আগে কখনো ওঠেনি। সোমবার একদিনেই প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার গোলাপ কেনাবেচা হয়েছে গদখালীর পাইকারি ফুলের বাজারে। পাশাপাশি গ্লাডিওলাস, জারবেরা ও রজনীগন্ধা ফুলের দামও ছিল চড়া।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দিবস দুটি ঘিরে এই অঞ্চলের চাষিরা গত একসপ্তাহে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করেছেন। এবার চড়ামূল্যে ফুল বিক্রি করতে পারায় গত দুই বছরের করোনা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে ফুলচাষিরা আশাবাদী। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আরও ফুল বিক্রি হবে। সেই হিসেবে এবার ৫০ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হবে এক মাসেই।
যশোরের ঝিকরগাছা গদখালী ও পানিসারা অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে চাষিরা ফুলখেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রয়োজনমাফিক পানি দেওয়া, স্প্রে করা, আগাছা নিড়ানো, মরা-রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলাসহ খেত পরিচর্যায় তাদের দম ফেলার সময় নেই। পাশাপাশি খেত থেকে ফুল তুলে নিয়ে ছুটছেন গদখালি ফুলবাজারে। দূর-দূরান্তের ক্রেতারাও হাজির হচ্ছেন সেখানে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণা আর হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠছে গোটা এলাকা।

গোলাপ, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস ফুলের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শত শত ফুলচাষি। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফুলের দাম নিয়ে হাঁকডাকে ব্যস্ত। 
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, যশোরে প্রায় সাত হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। তারা সাত শতাধিক হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। গদখালী, পানিসারা, নাভারন, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে ফুল চাষ হয়ে থাকে। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, ক্যালেন্ডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে।

ডিসেম্বরে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস থেকে শুরু ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস এবং মার্চে স্বাধীনতা দিবস ও পরে পহেলা বৈশাখ দিয়ে গোটা মৌসুম জুড়ে ফুল বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের ফুলচাষিরাই দেশের ৭০ ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়।

গদখালী ফুলবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বসন্ত ও ভালবাসা দিবস ঘিরে ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়েছে। লাল গোলাপ ফুল প্রতি পিস ২০-২২ টাকা, চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ ৩০-৩৫ টাকা, ক্যাপ গোলাপ ১০-১২ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক ১১-১২ টাকা, গ্লাডিওলাস ফুল রঙ ভেদে ১৪-১৫ টাকা, ভুট্টা ১১-১২ টাকা, জারবেরা প্রতিটি ১০-১৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পাশাপাশি চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৪ টাকায়, গাঁদা প্রতি হাজার সাড়ে তিনশ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা, রডস্টিক প্রতি বান্ডিল ১৫০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতি আঁটি ১০০ টাকা, মকমল ৪-৫ টাকা, ভ্যারাইটিস ৭-৮ টাকা, হলুদ ১৪-১৫ টাকা, সিঁদুর ১৫-১৫ টাকা, বিশ^সুন্দরী ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 
গদখালী বাজার কমিটি ও গ্রোয়ার্স সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল হোসেন জানান, এবার ফুলের বাজার খুবই জমজমাট। ফুলের দামে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা খুবই খুশি। ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন জানান, সোমবার তিনি প্রায় আড়াই লাখ টাকার ফুল ক্রয় করেছেন। তিনি চারটি জেলায় তার ক্রয়কৃত ফুল বিক্রি করবেন। 
ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী ওজিয়ার রহমান জানান, শুধু সোমবারেই প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি হাবিবুর রহমান জানালেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ফুলের চাষ ও উৎপাদন ভাল হয়েছে। তিন উৎসব ঘিরে ফুলবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ভাল বেচাকেনা হচ্ছে। বাজার পরিস্থিতিতে ফুলচাষিরা খুশি। ফুলখেতে পরিচর্যা করতে করতে চাষি গোলাম রসুল জানালেন, এখন দম ফেলার ফুরৎ নেই। শেষ মুহূর্তে গাঁদা খেত পরিচর্যা করে ফুল ধরে রেখে বাজারে তুলতে হবে। ফুলের মান ভাল থাকলে ভাল দাম পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, করোনাভাইরাস ও আম্ফান ঝড় এই অঞ্চলের ফুল সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা। গতবছর বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে প্রায় ২৫ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়েছিল। এর আগের দু’বছর চাষিরা কোনো ফুলই বিক্রি করতে পারেনি। এ বছর আবহাওয়া ভাল হওয়ায় ফুল চাষের জমি যেমন বেড়েছে, তেমনি উৎপাদনও হয়েছে ভাল। একইসঙ্গে বাজার পরিস্থিতি ভাল হওয়ায় আশা করা হচ্ছে, বেচাকেনা গত বছরের দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।
ঝিকরগাছার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, ঝিকরগাছার ৬৩০ হেক্টর জমিতে ৭২ প্রজাতির ফুল চাষ হয়ে থাকে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং যথাসময়ে শীত পড়ায় ফুলের উৎপাদন ভাল হয়েছে। পাশাপাশি পোকার আক্রমণও অনেক কম। এ কারণে ফুল বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।

×