ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

রেকি করে ছোট ছোট অপারেশনে অংশ নিয়েছি

মো. খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রেকি করে ছোট ছোট অপারেশনে অংশ নিয়েছি

মাসুদা সুলতানা

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের সব স্তরের মানুষ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা। হানাদারদের বিরুদ্ধে এদেশের যারা মরণপণ লড়াই করেছেন তাদেরই একজন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এলাকার নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদা সুলতানা।
তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর-০১৬৭০০০২২৮১। বেসামরিক গেজেট নম্বর-১৬৯৭। তাঁর স্বামী মীর মোহাম্মদ আমান উল্ল্যাহ। তাঁর স্বামীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর-০১৬৭০০০২২৮০। লাল মুক্তিবার্তা নং-০১০৪০৭০১০১, বেসামরিক গেজেট নম্বর- ১২১৬। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। গোদনাইলের মীরপাড়ার বাসায় দৈনিক জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি রোমন্থন করেন তিনি। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
মাসুদা সুলতানা ছোট ছোট অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে গোদনাইল এলাকাতেই হত্যা করা হয় দুজন পাক সেনাকে। আর এ অপারেশন করার আগে রেকি কর্ম সম্পাদন করেছেন মাসুদা। কোথা থেকে, কোন পথে, কখন, কোথায় যায় পাক সেনারা এসব রেকি করেছেন মাসুদা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো তার নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র জোগান দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। 
তিনি বলেন, আমারসহ বিভিন্ন জনের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে অপারেশনের পরিকল্পনা করা হতো। অপারেশনের আগে মহিলাদের সতর্ক করে দিয়ে আসতাম। গ্রামের লোকজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমি অবহিত করেছি। গ্রামবাসীকে কিছুক্ষণের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে কিংবা খুবই সতর্কতার সঙ্গে থাকতে অনুরোধ করেছি। তিনি বলেন, অস্ত্র-গোলাবারুদ জোগান দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংবাদ আদান-প্রদান করেছি। অপারেশন শেষে আবার অস্ত্রগুলো গোপন স্থানে রেখে দিয়েছি এবং মুক্তিসেনাদের গোপন আস্তানায় পৌঁছে দিয়েছি। মুুক্তিযুদ্ধের সময় এ ধরনের নানা কাজে অংশ নিয়েছি। 
মাসুদা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এক প্রকট শব্দ শুনে আমার ও আমার স্বামীর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। কারণ বুঝতে পেরে আমরা দুজনে দ্রুত দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলাম। রাত শেষে ভোর হতেই মীর আমান ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় চুপি চুপি বাড়ি ফিরে জানালো দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পরে আমরা দুজনে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। মাসুদা বলেন, তার ইচ্ছে ছিল ভারতে গিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেবেন। কিন্তু ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। তিনি দেশের মাটিতেই অবস্থান করেন।

তবে অস্ত্রধারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে দেশে আসার পর মাসুদা অস্ত্রগুলো নাড়াচাড়া করতেন। ধীরে ধীরে ছোট ছোট আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর প্রশিক্ষণ শিখে নেন। একটি স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র নাড়াচাড়া করার সময় হঠাৎ একটি গুলি বের হয়ে ঘরের চাল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। কিন্তু রক্ষা, পাক সেনারা বিষয়টি বুঝতে পারেনি। 
মাসুদা বলেন, জালকুড়ি গিয়েও অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করেছি। আমার নিজের বাড়িও ব্যবহৃত হতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। এভাবেই আমি অস্ত্র চালানো শিখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। 
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মাসুদা বলেন, আমার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আমান উল্ল্যাহ ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তবে তাঁর স্বামী মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে লাগাতে। মাসুদা বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর স্বামীর মনে একটা অতৃপ্তি কাজ করত।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে পরিবারের সম্মতিতে ২০০৯ সালে তিনি তাঁর দেহ চিকিৎসা বিভাগের কাজে লাগাতে মনস্থির করেন। এজন্য তিনি প্রায়ই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগে যাতায়াত করতেন। সেখানে দেহ দান করার বিষয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। তাই তার মৃত্যুর পর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার মরদেহ ঢাকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগে দান করা হয়েছে। এভাবেই আমরা স্বামী-স্ত্রী দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

×