ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

অল্পের জন্য রক্ষা পাই আমরা

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

অল্পের জন্য রক্ষা পাই আমরা

আনোয়ার হোসেন রতু

মুক্তিকামী নিরীহ মানুষের বাড়িঘর দাউ দাউ করে জ¦লতে দেখা যায়। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সেই নিদের্শনায় সারাদেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জেও গঠিত হয়েছিল মহুকুমা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন মোতাহার হেসেন তালুকদার আর সদস্য সচিব ছিলেন আনোয়ার হোসেন রতু। রতুর সহধর্মিণী সৈয়দা ইসাবেলাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ এবং সে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে স্মৃতিচারণ করে আনোয়ার হোসেন রতু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের দুটি অংশ- প্রতিরোধ যুদ্ধ ও সশস্ত্র যুদ্ধ। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেননি। এ কথার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ২৭ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরে পাকি হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ ছিল অবরুদ্ধ অঞ্চল। ২৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পাকি হানাদার বাহিনীর ইতিহাসের নিষ্ঠুুরতম বর্বর নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। দাউ দাউ করে জ¦লতে দেখা যায় মুক্তিকামী নিরীহ মানুষের বাড়িঘর। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে হানাদার বাহিনী।

মহুকুমা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে আমি নিজে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, এক চর থেকে যমুনা নদীর আরেক চর, কখনো নৌকায়, আবার কখনো হেঁটে হেঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করি। শরণার্থী জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সংগঠক হিসেবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে রাত যাপন করা; সে এক দুর্বিসহ জীবন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে কখানা পিছপা হইনি।
তৎকালীন এমপিএ সৈয়দ হায়দার আলীর পরিবারসহ আরও কয়েক পরিবারের শিশু, নারী, পুরুষ নৌকায় তুলে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাবার পথে একদিনের একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বহনকারী পালতোলা নৌকা যখন বাহাদুরাবাদঘাটের কাছে পৌঁছে তখন পাক সেনারা স্পীডবোট নিয়ে নৌপথ পাহারায় ছিল। নৌকার মাঝি নড়াচড়া করতে বারণ করলেন এবং সবাইকে নৌকার ছৈয়ের নিচে চুপচাপ বসে থাকতে বললেন।

নৌকার সামনে এবং পেছনে কাঠ, খড়ি সাজিয়ে মাঝি-মাল্লারা পালতোলা নৌকার দাঁড় ধরলেন। সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা আমির হোসেন ভুলু লুঙ্গি পরে, গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মাথায় বাঁধলেন গামছা। এর পর তিনি ধরলেন হাল। শ^াস-প্রশ্বাস বন্ধ করে আমরা সবাই শুয়ে আছি নৌকার ভেতরে হাত-পা গুটিয়ে। মহিলারা তসবিহ তেলাওয়াত করছেন। সবাই দোয়া-দরুদ পড়ছেন, দোয়া ইউনুস পড়ছেন।

নদীতে পাহারারত হানাদার বাহিনীর স্পীডবোট দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই।  পাক সেনারা টের পাবার আগেই আমাদের নৌকা পার হয়ে যায়। আমরা অল্পের জন্য রক্ষা পাই। মাঝি হাঁফ ছেড়ে বললেন, আর ভয় নেই। পাক সেনাদের পাহারা চৌকি পেরিয়ে আমরা অনেকদূর চলে এসেছি।

×