
সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ বগুড়া নগরীর প্রধান সব সড়ক এক হয়ে মিশে গিয়েছে একটি কেন্দ্রস্থলে। প্রাচীন আমলেই নামকরণ হয় সাতমাথা। অতীতে এই সাতমাথায় ছিল বিরাট বটবৃক্ষ। প্রায় দুশ’ বছর আগে বগুড়া জেলার গোড়াপত্তন। ওই সময় ব্রিটিশ শাসনামলের কালেক্টরেটের কাছে জমিদার ও পাইক পেয়াদা আসতো গরুর ও মহিষের গাড়িতে চড়ে। সাতমাথার কাছে গরু ও গাড়ি রেখে যেত কালেক্টরেট অফিসে। ইতিহাসের অনেক পট পরিবর্তনে এই সাতমাথা থেকে শুরু মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের অনেক পরে কৃতজ্ঞ জাতি সাতমাথার নামকরণ করে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ার।
দিনে দিনে বগুড়া নগরীর বিস্তৃতি বেড়েছে। ১৮৭৬ সালের ১ জুলাই ১৪ দশমিক ৭৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বগুড়া পৌরসভার বর্তমান আয়তন ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের বৃহত্তম পৌরসভা। ১২টি ওয়ার্ড বেড়ে হয়েছে ২১টি। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। ঐতিহ্যের এই সাতমাথার দুঃখ আজও মোচন হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায় সাতমাথা ও সংযুক্ত প্রতিটি সড়ক। এই পানি সরতে সময় নেয় অনেক। সকল যানবাহন প্রায় অর্ধেক পানিতে ডুবে চলাচল করে। বগুড়া নগরীর দক্ষিণের বনানী থেকে উত্তরে মাটিডালি এবং সাতমাথা থেকে জাতীয় মহাসড়কের সংযুক্ত তিনমাথা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়ক চওড়া নির্মাণের সময় ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে দেয়ার কোন প্রকল্প ছিল না। ফলে প্রধান সড়ক কবি নজরুল ইসলাম রোড সংযুক্ত সাতটি সড়কেই ভারি বৃষ্টিতে ডুবে যায়। পৌরবাসী পৌরপিতার কাছে বহু আবেদন নিবেদন করেছে কাজ হয়নি।
সাতমাথাকে কেন্দ্র করে পৌর এলাকায় যে সড়কগুলো আছে পাকা ও কাঁচা মিলে তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫শ’ কিলোমিটার। ড্রেনের দৈর্ঘ্য পাকা ৪৮০ কিলোমিটার ও কাঁচা ৪শ’ কিলোমিটার। বগুড়া পৌরসভা ১৯৮১ সালে ‘ক’ শ্রেণীর মর্যাদা পায়। তারপরও বগুড়া নগরীর বর্ধিত পৌর এলাকার অবস্থা খুবই নাজুক। মনে হবে গ্রাম। যেখানে ইটভাঁটিও রয়েছে। বগুড়া সভার চারদিকের যত এলাকা আছে সেই এলাকার বাসিন্দাদের প্রিয় জায়গা সাতমাথা। এই কেন্দ্রস্থলে না এলে তাদের মন আনচান করে। বিশেষ করে বিকালের পর সাতমাথার অতি নিকটে প্রধান ডাকঘরের সামনে কৃষ্ণচূড়া চত্বর যেন আড্ডার মহামিলন। কেউ কারো সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ঠিকানা একটাই সাতমাথা। তারপর সাবস্টেশনের মতো কোন ভ্রাম্যমাণ চায়ের স্টলে। এই আড্ডা চলে মধ্যরাত অবধি।
বগুড়া নগরীর সাতমাথার যানজট প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপ নিয়েছে। সকাল থেকে মধ্যরাত। যানজট লেগেই আছে। শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি রেলগেট এই জট আরও বাড়িয়েছে। রেলগেট বন্ধ হলে সব পথ রুদ্ধ। সন্ধ্যা থেকে কবি নজরুল ইসলাম রোডের ধারে কোন পেশাজীবীর মোটরসাইকেল এমনভাবে স্ট্যান্ড করা হয় মনে হবে মোটরবাইকের গ্যারেজ। তার ধারে থ্রিহুইলার গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে চওড়া সড়ক সঙ্কুচিত করে দেয়। দিনের জট একরকম রাতের জট আরেক রকম। জট আর কমে না। দিনে রাতে সমানে ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির ফুড়ুত ফুড়ুত লেগেই আছে। রিক্সাগুলোর বডিতে লাঠির বাড়ি পড়ছে। কেউ কথা শোনে না। বগুড়া নগরীতে যানবাহন যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানজট। এই জট সাতমাথাকেও ছাড়ছে না।
ঐতিহ্যের সাতমাথার ইতিহাসে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরই প্রধান সাতটি সড়ক দিয়ে বন্যার মতো মিছিলের ঢেউ এসে মিলিত হয় এই সাতমাথায়। গর্জে ওঠে বগুড়ার দামাল ছেলেরা। ২৫ মার্চ কালরাতে এই সাতমাথার ফের তরুণরা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে হানাদার পাকিস্তানী সেনার বিরুদ্ধে। কাছের রেলস্টেশন থেকে মালগাড়ি ঠেলে সাতমাথা থেকে প্রায় একশ’ মিটার উত্তরে দুই নম্বর রেলগেটে এনে রুদ্ধ করা হয় প্রবেশ পথ। এই সাতমাথা থেকেই পর হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এক পর্যায়ে হানাদার সেনাবাহিনী পিছু হটে। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত থাকে বগুড়া। তখন মুক্ত সাতমাথায় বিজয়ের উল্লাস। পরদিন বিকালে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর দুটি স্যাবারজেট যুদ্ধ বিমান সাতমাথায় বোমা বর্ষণ করে। তারপর দুদিক থেকে সেনাবাহিনী প্রবেশ। শুরু হয় গণহত্যা ও লুটপাট। বীর তরুণরা লোকালয় ছেড়ে প্রস্তুতি নেয় মুক্তিযুদ্ধের। দীর্ঘ ন’মাস মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এই সাতমাথা ফের ফিরে পায় মুক্ত স্বাধীনতার স্বাদ। কত ইতিহাস রচিত হয়ে আছে এই সাতমাথায়।
একবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সাতমাথায় ঘুনপোকার প্রবেশ ঘটে। সাতমাথায় সৌন্দর্যহানি করতে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ারের চারধারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পোস্টার ও ব্যানার আঁটা শুরু হয়। ঢেকে যায় বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতিকৃতি। ভিতরে ময়লা আবর্জনা ফেলে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবিকে অবমাননা করা হয়। বছর কয়েক আগে বগুড়া ফটো জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন নিজস্ব উদ্যোগে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ারকে পরিষ্কার রাখতে ব্যবস্থা নেয়। পৌর কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা দেয়। ওই সময় সাতমাথা পরিষ্কার থাকে। বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ারের ভিতরে সৌন্দর্যবর্ধক গাছ লাগানো হয়। বছর দুয়েক এভাবেই ছিল। তারপর কোন এক ঘুনপোকা স্কোয়ারের চারধারে ব্যানার ফেস্টুন লাগানো শুরু করে। বাধা দিলে পেশিশক্তি প্রদর্শন করে। সাতমাথার আশপাশে সৌন্দর্য রক্ষা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ আর কেউ নেয়নি। নগরীর সাতমাথার সাতকাহনের কান্না থামছে না।