ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হাইবারির বাতাসে যেন ফিসফিসানি; স্টেডিয়ামে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে সাবেক তারকার আত্মা

মাইয়া নৌমি, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:২২, ৩০ মে ২০২৫; আপডেট: ০১:২৩, ৩০ মে ২০২৫

হাইবারির বাতাসে যেন ফিসফিসানি; স্টেডিয়ামে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে সাবেক তারকার আত্মা

যেখানে কান পাতলেই ধ্বনিত হতো অসংখ্য মানুষের উল্লাস, সেখানে আজ ইমারতের গায়ে শ্যাওলা ধরেছে, ইটের দেয়ালে জন্মেছে পরগাছা, ঘাস-লতা। উত্তর লন্ডনের এক শান্ত কোণে, সবুজে ঘেরা নগরীতে ইট পাথরের এক দুর্গ; হাইবারি শুধু একটি ফুটবল স্টেডিয়াম ছিল না, ছিল কিংবদন্তি ক্লাব আর্সেনালে হৃৎস্পন্দন। দীর্ঘ ৯৩ বছর ধরে কত হাসি-কান্না, কত জয়-পরাজয়ের সাক্ষী এই মাঠ, যা আজ শুধু কিছু স্মৃতি আর কিছু অট্টালিকার আবরণে মোড়া। তবুও ফুটবল ইতিহাসের পাতায় হাইবারি আজও এক নস্টালজিক অধ্যায়, যেখানে প্রতি ধূলিকণায় মিশে আছে কত কিংবদন্তির স্বপ্ন, জয়-পরাজয়ের গল্পগাথা।

সবকিছুর বাইরেও আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের প্রাক্তন হোম গ্রাউন্ড এই হাইবারি স্টেডিয়াম পরিচিত কিছু অদ্ভুত ভুতুড়ে গল্পের জন্যও। যদিও এখন এটি একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়েছে তবুও, এর অতীত ইতিহাস এবং কথিত অলৌকিকত্বের সাথে জড়িয়ে আছে ক্লাব কিংবদন্তি হারবার্ট চ্যাপম্যানের অন্তর ও আত্মা।

১৯১৩ সালে নির্মিত হাইবারি স্টেডিয়াম ছিল আর্সেনালের ৯৩ বছরের ফুটবল ইতিহাসের সাক্ষী। বহু অতীতের সাক্ষী এই স্টেডিয়ামের অতীতের সাথে ভৌতিক গল্পের মিশ্রণ প্রায়শই দেখা যায়। হাইবারি স্টেডিয়ামকে "ভুতুড়ে" বলার অন্যতম প্রধান কারণ হলো আর্সেনালের কিংবদন্তি ম্যানেজার হারবার্ট চ্যাপম্যানের আত্মার কথিত উপস্থিতি। চ্যাপম্যান ১৯২৫ সালে আর্সেনালে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন এবং তাঁর হাত ধরেই আর্সেনাল ১৯২৩-২৪ এবং ১৯২৪-২৫ সালে প্রথম লিগ শিরোপা জেতে। তিনি আলেক্স জেমস এবং ক্লিফ বাস্টিনসহ অনেক নামীদামী খেলোয়াড়কে দলে টেনে এনে আর্সেনালকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

১৯৩৪ সালের ৬ জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হারবার্ট চ্যাপম্যানের মৃত্যু হয়। তাঁর জীবনের শেষ ক'দিন তিনি এই স্টেডিয়ামে বসেই খেলা দেখেছিলেন। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীদের এবং স্টেডিয়ামের কর্মীদের মধ্যে একটি প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে, চ্যাপম্যানের আত্মা এখনও হাইবারি স্টেডিয়ামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। কথিত আছে, তাঁর প্রিয় স্থানগুলোতে, বিশেষ করে ম্যানেজারের চেয়ারে অথবা ড্রেসিং রুমের কাছাকাছি তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যায়। কেউ কেউ নাকি আবছায়া রূপে তাঁর আত্মাকে দেখেছেন বলেও দাবি করেন। স্থানীয় মানুষ এবং আর্সেনাল ভক্তদের মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে এই গল্পগুলো প্রচলিত হয়েছে, যা হাইবারিকে ধীরে ধীরে একটি "ভুতুড়ে" স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

আসলে চ্যাপম্যান আর্সেনালের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ম্যানেজারদের একজন ছিলেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু ক্লাব এবং ভক্তদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। এই কারণেই তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা স্টেডিয়ামটিতে তাঁর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে এমন গল্পের জন্ম দিয়েছে। এটি কোনো ভয়ংকর বা অশুভ আত্মার উপস্থিতি নয়, বরং তাদের একজন প্রিয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর অমরত্ব প্রকাশের একটি উপায়।

২০০৬ সালে আর্সেনাল তাদের নতুন হোম গ্রাউন্ড এমিরেটস স্টেডিয়ামে স্থানান্তরিত হওয়ার পর হাইবারি স্টেডিয়াম ভেঙে দেওয়া হয়। বর্তমানে এর জায়গায় একটি আধুনিক আবাসিক কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। স্টেডিয়ামের মূল স্থাপত্যের কিছু অংশ যেমন পূর্ব এবং পশ্চিম স্ট্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ফাসাদগুলো অক্ষত রাখা হয়েছে এবং খেলার মাঠের জায়গায় এখন একটি সুন্দর বাগান তৈরি করা হয়েছে।

নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো হাইবারি শুধুই একটি পুরনো স্টেডিয়ামের নাম, কিন্তু প্রবীণ গানার সমর্থকদের হৃদয়ে হাইবারি আজও এক জীবন্ত আবেগ, হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি। এই ভূমিতে রচিত হয়েছে কত না অমর গাথা, যেন আজও ফিসফিস করে ধ্বনিত হয় পুরনো গ্যালারির নীরবতায়। আজও যেন ডাগ আউটে বসে মাঠের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রেখে চলেছে এক হারবার্ট চ্যাপম্যান।

মিমিয়া

×