ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফুটবলে নবজাগরণের ডাক

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:২৩, ৩১ মে ২০২৫

ফুটবলে নবজাগরণের ডাক

.

অনেকে এই উন্মাদনাকে নব্বইয়ের দশকের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে সে সময় ফুটবল ছিল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা; সেটা ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক দুই অঙ্গনেই। ঘরোয়া লিগের ম্যাচের টিকিট নিয়ে কত তুলকালাম কা-ই না ঘটেছে। গত তিন দশকে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যেভাবে বেড়েছে একইভাবে পিছিয়েছে ফুটবল। ঘরোয়া ফুটবল ক্রমশ তারকাশূন্য হয়ে পড়া, আন্তর্জাতিক আঙিনায় একের পর এক ব্যর্থতা এর বড় কারণ। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল লিগ ইংলিশ প্রিমিয়ারে (ইপিএল) খেলা হামজা দেওয়ান চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার পর হঠাৎই বদলে যায় দৃশ্যপট। ফুটবল ঘিরে তৈরি হয় নতুন আগ্রহ। আগামী ১০ জুন ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুরের মুখোমুখি হবে জাতীয় ফুটবল দল। হামজা তো আছেনই এই ম্যাচ দিয়েই জাতীয় দলে অভিষেক হতে পারে কানাডা প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলা সামিত সোম এবং ইতালিয়ান প্রবাসী ফাহমিদুল ইসলামের। সংস্কারের পর মনমাতানো নতুন চেহারা পেয়েছে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়াম।
কেবল ফুটবল নিয়ে আলোচনাই নয়, হামজা-সামিতদের এই সূচনালগ্নে ফুটবলে যে দিন বদলের শুরু, সেটা নামি-দামি কোম্পানির স্পনসর করার আগ্রহ এবং টিকিটের মূল্য দেখলেও অনুমান করা যায়। ফুটবলে শেষ কবে টিকিটের সর্বনিম্ন দাম ৪০০ টাকা ছিল বলা কঠিন। টিকিট দূরে থাক, বিনা মূল্যে ম্যাচ দেখার ব্যবস্থা করেও খুব একটা দর্শক টানা যায়নি। দীর্ঘদিন পর হামজাদের ঘিরে ফুটবলে যখন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে তখনই আবার বড় বড় প্রতিষ্ঠান ফুটবলের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিট স্পনসর হিসেবে ‘দৌড়’কে পেয়েছে বাফুফে। জাতীয় দলের স্পনসর হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট ক্যাম্পেনে যুক্ত হয়েছে মোবাইল অপারেটর রবি। প্রথমবারের মতো ফুটবল স্পনসর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বিশ্বখ্যাত জাপানি প্রতিষ্ঠান মলটেন। এছাড়া সিঙ্গাপুর ম্যাচের জন্য টাইটেল স্পনসর এবং তিন থেকে চারটি কো-স্পনসরও পেয়েছে বাফুফে। প্রথমবার জাতীয় ফুটবল দলের কোনো ম্যাচের টিকিট বিক্রি হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। সেখানেও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ভক্ত-সমর্থকরা। সর্বোপরি এএফসি এশিয়ান কাপে বাছাই পর্বের এই ম্যাচ ঘিরে বাংলাদেশের ফুটবলেই যেন নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ মার্চ শিলংয়ে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে হামজা চৌধুরীর। সেই ম্যাচে ভারতকে তাদেরই মাটিতে গোলশূন্য ড্র করে রুখে দিয়েছেন টাইগাররা। এতে এশিয়া কাপে খেলার সম্ভাবনা বেড়েছে লাল-সবুজের। এই সাফল্যের নেপথ্যের বড় নায়ক হামজা। প্রথমবার বাংলাদেশের জার্সিতে মাঠে নেমেই দেশের ফুটবল ভক্তদের মন কেড়েছেন। 
বাংলাদেশ কেন হামজাকে এমন করে চেয়েছে, তার ছাপটা স্পষ্ট ছিল খেলায়। শেফিল্ড ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডার অভিষেকেই আলো কেড়ে নিয়েছেন। তাতেই ভারত কেঁপে উঠেছে রীতিমতো। তিনি যেমন পারফর্ম করেছেন, তাতে বাংলাদেশ দল তার অভিষেকে সেরা উপহারটা দিতে পারত একটা জয় দিয়ে। কিন্তু ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় সেটি হয়নি। যেহেতু মিডফিল্ডার, তার পজিশনটা ছিল মাঝমাঠে ডবল পিভোটে। সেখানে নিজের কাজটা তিনি ঠিকঠাকই করে গেছেন। প্রতিপক্ষের সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে হামজা ছিলেন জয়ীর ভূমিকায়। কিন্তু বরাবরের মতো ভালোমানের স্ট্রাইকারের অভাবে গোলের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। ২০১৫ মৌসুমে ইপিএলের অন্যতম ক্লাব লিচেস্টার সিটিতে খেলা হামজা, এরপর ব্রাইটন অ্যালবিয়ন, ওয়াটফোর্ড হয়ে এবারের মৌসুমে খেলেন শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে। গত মার্চে লন্ডন থেকে তিনি যেদিন দেশে আসেন, পূর্বপুরুষের ভিটা সিলেটে পা রাখেন, ভক্ত-সমর্থকদের ¯্রােতে অভাবনীয় এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। বাংলাদেশের ফুটবলে যা বিরল। বিশ্লেষকদের মতে, হামজার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের ফুটবলের ব্র্যান্ড ভেল্যুই বাড়িয়ে দিয়েছে। ২৭ বছর বয়সী সামিত সোম ইতোমধ্যে কানাডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে নতুন বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এই মৌসুমে ক্লাব ক্যাভালরি এফসির হয়ে কানাডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলা এই ফুটবলার মিডফিল্ডে শক্তিমত্তা ও ভারসাম্য এনে দিতে পারেন। ফাহমিদুলের এখনো বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো হয়নি। তবে ১৮ বছর বয়সী লেফট উইঙ্গার এর আগেই দেশের ফুটবল ভক্তদের কাছে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। বিশেষ করে গত মার্চে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ক্যাম্পে ডাক পেলেও চূড়ান্ত দলে জায়গা পাননি এই ইতালি প্রবাসী। তাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফুটবলপ্রেমীদের জন্য সুখবর, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের আসন্ন ম্যাচের জন্য ফের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন ফাহমিদুল। শুক্রবার শুরু জাতীয় দলের ক্যাম্পে শুরু থেকেই তাকে পেয়ে গেছেন কোচ ক্যাবরেরা। দুই- একদিনের মধ্যেই যোগ দেবেন হামজা ও সামিত।   
দীর্ঘ লাইন নাই, ধাক্কাধাক্কি নাই, পাড়াপাড়ি নাই, তাই হুলস্থুল, তুলকালাম শব্দগুলো শোনা যায় কি না, প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে টিকিট নিয়ে যা হচ্ছে সেটিকে নজিরবিহীনই বলতে হবে। বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ নিয়ে দর্শকের আগ্রহের শেষ নেই। ঠিক কত বছর পর বাংলাদেশের কোনো ফুটবল ম্যাচ নিয়ে দর্শকের এত উন্মাদনা, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। প্রথমবার বাংলাদেশের কোনো ফুটবল ম্যাচের জন্য অনলাইনে টিকিটি বিক্রি করা হয়। এতটাই চাহিদা ছিল টিকিটের, যে গত ২৪ মে অনলাইনে টিকিট ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে হামলে পড়েন লাখো টিকিটি প্রত্যাশী। চাপে সার্ভার জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় বিক্রি। অনেক ঝামেলার পর ২৬ তারিখ রাতেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়।  উন্মাদনার ম্যাচে দর্শকদের জন্য চমক আছে বলে জানিয়েছেন বাফুফের সহ-সভাপতি ফাহাদ করিম, ‘এটা শুধুই একটা ম্যাচ নয়। ফুটবলের জন্য বিশেষ একটা দিন। যেদিন থেকে বাংলাদেশের ফুটবল নতুন করে পথ চলতে শুরু করবে। আমাদের বিশ্বাস, দর্শকরা হামজা-সামিতদের ম্যাচটা দারুণভাবে উপভোগ করবেন।’ কেবল ৯০ মিনিট খেলা নয়। দর্শকদের জন্য লেজার শো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফ্যানজোন, বিশেষ বাস-মেট্রোরেল সুবিধার কথাও ভাবছে বাফুফে,‘দর্শকরা এরই মধ্যে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা এখন ফুটবল দেখছেন, খোঁজখবর রাখছেন। ১০ তারিখ যখন হামজাদের ম্যাচ দেখতে আসবেন তারা, আমরা চাই তাদের একটা ভালো অভিজ্ঞতা দিতে। তাদের জন্য একটা চমক থাকবে, যেটা বাংলাদেশের স্পোর্টসে আগে কখনো হয়নি। বাংলাদেশ কেন দক্ষিণ এশিয়ায়ও হয়নি।’ 

প্যানেল

×