
জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম টেস্টে অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজের উচ্ছ্বাসটাও বাঁধভাঙা
দেওয়ালে ঠেকলে পিঠ, লড়াই জীবন। তারই প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল চট্টগ্রাম টেস্টে। ব্যাটে-বলে সেই লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডানহাতি অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। বুধবার টেস্টের তৃতীয় দিন তার ব্যাট থেকে এসেছে সেঞ্চুরি। বল হাতে আবার ৫ উইকেট নিয়ে একাই প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়েকে বড় পরাজয় বরণে বাধ্য করেছেন। সিলেট টেস্টে হারের তিক্ততা নিয়ে তাই চট্টগ্রামে মাত্র ৩ দিনেই ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল ব্যবধানে জিতে গেছে বাংলাদেশ দল।
এই জয়ে সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করেছে বাংলাদেশ। বুধবার ম্যাচের তৃতীয় দিন একাই জ¦লজ¦লে পারফর্ম্যান্স দেখিয়ে মহানায়ক হয়ে গেছেন মিরাজ। তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৪৪৪ রান তুলে লিড পেয়েছে ২১৭ রানের। টেস্টে ২ হাজার রান পূর্ণ করে দেশের দ্বিতীয় ও টেস্ট ইতিহাসের ২৬তম ক্রিকেটার হিসেবে অসাধারণ এক কীর্তি গড়েছেন মিরাজ। কারণ ২ হাজার রানের পাশাপাশি ২০০ উইকেটও আছে তার।
তার বোলিংয়ে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংস ধসে পড়েছে ১১১ রানে। একই টেস্টে শতরান এবং ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া তৃতীয় বাংলাদেশী মিরাজ। সাগরিকার এই মাঠ নতুন নাম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়াম তাই যাত্রা শুরু করেছে স্বাগতিকদের জয় নিয়ে।
২০১৮ সালে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম টেস্টে যাত্রা শুরু করে। সেবার জিম্বাবুয়ের কাছে ১৫১ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর একই ভেন্যুতে এবার নেমে তাদের কাছেই ৩ উইকেটে হেরে চরম সমালোচিত হয় টাইগাররা।
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া বাংলাদেশ চট্টগ্রামের সাগরিকায় প্রথম দিন থেকেই দারুণ অবস্থানে। সেটি দৃঢ় হয় দ্বিতীয় দিন প্রথম বলেই যখন জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংস ২২৭ রানে থেমেছে। এরপর ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে। প্রথম ইনিংসে মিরাজ কোনো উইকেট পাননি, ব্যাট হাতেও দ্বিতীয় দিন শেষে ১৬ রানে অপরাজিত ছিলেন। তাই চট্টগ্রাম টেস্টে তার নামটাই আলোচনায় আসেনি। কিন্তু তৃতীয় দিন মহানায়ক হয়েছেন তিনি।
৭ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি অষ্টম উইকেটে তাইজুল ইসলামের সঙ্গে ৬৩ রানের জুটি গড়েন। তাইজুল ৪৫ বলে ৩ চারে ২০ রানে ফিরে যান। এরপর তানজিম হাসান সাকিবের সঙ্গে নবম উইকেটে ৯৬ রানের অবিশ^াস্য এক জুটি গড়েন মিরাজ। সেই পথে বাংলাদেশের লিড ২০০ পেরিয়ে যায়। তানজিম ৪১ রানে সাজঘরে ফিরলে মিরাজের শতক পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু হাসান মাহমুদ দৃঢ়তা দেখিয়ে ১৬ বল মোকাবিলা করে কোনো রানই করেননি। তার এমন দৃঢ়তার কারণে ৪ বছরেরও বেশি সময় পর আরেকটি সেঞ্চুরি পেয়ে যান মিরাজ।
২০২১ সালে চট্টগ্রামের এই মাঠেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৩ রান করেছিলেন। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি সেখানেই পেয়েছেন মিরাজ। সেবার আটে নেমে করেছিলেন সেঞ্চুরি এবার সাতে নেমে করেছেন ১৬২ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় ১০৪। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস থেমে যায় ৪৪৪ রানে। অভিষেকেই লেগস্পিনার ভিনসেন্ট মাসাকেসা জিম্বাবুয়ের তৃতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ৫ উইকেট নেন। তবে তার এই কীর্তি আর তাইজুলের প্রথম ইনিংসে নেওয়া ৬ উইকেটের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সকে পেছনে ফেলে জ¦লজ¦লে হয়ে উঠেছেন মিরাজ।
তাইজুলের বাঁহাতি স্পিন আর মিরাজের অফস্পিনে বিপর্যস্ত জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংস মাত্র ১১১ রানেই গুটিয়ে গেছে। ফলে ৩ দিনেই চট্টগ্রাম টেস্ট বাংলাদেশ জিতেছে ইনিংস ও ১০৬ রানে। ক্যারিয়ারে ১৩তম ৫ উইকেট নিয়েছেন মিরাজ। ২১ ওভারে ৮ মেডেন দিয়ে মাত্র ৩২ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি। ফলে সাকিব আল হাসানের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী এবং বিশে^র ২৬তম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ২০০ উইকেটের পাশাপাশি ২ হাজার রান পেরিয়ে যাওয়ার কীর্তি গড়েন মিরাজ।
সাকিব ৫৪ টেস্টে আর মিরাজ ৫৩ টেস্টে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। সেই সঙ্গে সাকিব ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তিও গড়েন। এমন রেকর্ডময় পারফর্ম্যান্সের জন্য জিম্বাবুয়ের কাছে ১৪ বছর পর টেস্ট সিরিজ হারের লজ্জা থেকে বেঁচে গেছে বাংলাদেশ। সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ হয়েছে টাইগারদের ২৩তম টেস্ট জয়ে। তবে এটি তৃতীয়বার ইনিংস ব্যবধানে জয়।
আর সবচেয়ে বড় একটি ফাঁড়া কাটিয়েছে বাংলাদেশ দল। ঘরের মাটিতে টানা ৬ টেস্ট হারের পর অবশেষে জয়ের মুখ দেখেছে টাইগাররা। মিরাজ ছাড়াও অবশ্য সাদমান ইসলামের ১২০ আর তাইজুলের প্রথম ইনিংসে ৬ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট শিকার যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। তবে সবাইকে ম্লান করে দিয়েছেন মিরাজ তার একক নৈপুণ্যে। তৃতীয়বার টেস্টে সিরিজ সেরা হয়েছেন তিনি এবং একই সমান ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছেন।
সাকিব ৫ বার সিরিজ সেরা হয়েছেন এবং ম্যাচসেরা হয়েছেন ৬ বার। তাই ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মিরাজ বলেছেন, ‘আপনি যেটা বললেন সাকিব ভাইয়ের অর্জন অনেক বেশি আমরা জানি। এই প্রশ্নটা সবাই দেখি করে। সাকিব ভাই সাকিব ভাইয়ের ভূমিকা পালন করেছে। আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে বোলিং দিয়ে। পরে ব্যাটিংটা উন্নত করেছি।
যেহেতু আমি ব্যাটিংটা পারি। আমি অবশ্যই সেভাবে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজের মতো করেই খেলতে চাই। তবে আমার মনে হয় আমার এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত, পারফর্ম করা উচিত।’