
ছবি: সংগৃহীত
ঝলসানো রোদে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের প্রধান চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে সায়েরা শক্ত করে ধরে ছিলেন স্বামী ফারহানের হাত। মুখে কালো নেটের বোরখা, কোলে নয় মাসের শিশু আজলান। বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু এই কয়েকটি মুহূর্ত যেন অনন্তকাল ধরে ধরে রাখতে চাইছেন তারা—ভিসা, পাসপোর্ট আর রাজনীতির নিষ্ঠুর নিয়মে ভেঙে যাচ্ছে একটি পরিবার।
ফেসবুকে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে—সায়েরা ও ফারহানের তিন বছরের সংসার কেটেছে স্বপ্নের মতো। পুরনো দিল্লির যুবক ফারহান পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। করাচির মেয়ে সায়েরার সাথে তিনি মিলিত হয়েছিলেন ভালোবাসায়। তাদের সংসারে আজলান নামের শিশুটি সেই ভালোবাসার সেতুবন্ধ।
কিন্তু ২২ এপ্রিল পেহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পরপরই পালটে যায় দৃশ্যপট। ভারত সরকার হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
ফারহান ও সায়েরা তখন রাতভর সফর করে পৌঁছান সীমান্তে, শিশু আজলানকে কোলে নিয়েই। সীমান্তে যখন কাঁটাতারের ফাঁকে বিদায় জানাচ্ছিলেন একে অপরকে, তখন ফারহান বলেছিলেন, ‘আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগিরই।’
কিন্তু হঠাৎই এক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বলেন, ‘এই শিশুটি যেতে পারবে না, ম্যাডাম। ওর পাসপোর্ট নীল, ভারতীয়।’
এক মুহূর্তেই ভেঙে গেল পরিবার। মা ফিরলেন করাচিতে, বাবা শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ফিরে গেলেন দিল্লিতে। শুধু আজলান নয়, যেন চিৎকার করে কেঁদে উঠল সীমান্তও।
ফারহানের বোন নূরিন বলেন, ‘আজলান তো মায়ের কোলে ঘুমায়, ফিডার চেনে না। আমরা কিভাবে বুঝাবো তাকে?’
বিদায়ের শেষ মুহূর্তে হঠাৎ এক সীমান্তরক্ষী ফারহানের নাম ধরে ডাকেন। তিনি দৌড়ে যান, ভেবেছিলেন, হয়তো এবার মায়ের কোলে ফিরবে আজলান। কিন্তু না, ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসেন হতাশ হয়ে। কোলে কান্নায় ভেঙে পড়া শিশুটি।
‘সায়েরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল’, বলেন ফারহান, ‘জ্ঞান ফিরলেও শুধু কাঁদছিল’।
পুরনো দিল্লির ইলেকট্রিশিয়ান ফারহান বলেন, ‘সায়েরা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। আজ আবার সব বদলে গেল, আমি একা হয়ে গেলাম।’
কেবল সায়েরা একা নন। এমনই মানবিক সংকটে পড়েছেন বহু নারী—যাদের হৃদয়ের ঠিকানা এক দেশ, আইনি পরিচয় আরেক দেশ। ৪৮ বছরের হালিমা বেগম ২৫ বছর আগে বিয়ে করে করাচি থেকে উড়িষ্যা এসেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে নিয়ে কাটাচ্ছিলেন দিন। হঠাৎই হাতে এল ‘ভারত ছাড়ো’ নোটিশ।
‘আমার বাপ-দাদার কবর এখানে, আমার ছেলেরা এখানে বড় হয়েছে, আমি যাব কোথায়?’ বলেই চোখ মুছলেন হালিমা।
তার দুই ছেলে, ২২ বছরের মুসায়িব ও ১৬ বছরের জুবায়ের। তারা চেয়েছিল মায়ের সঙ্গে যেতে। কিন্তু তাদের ভারতীয় পাসপোর্ট সীমান্তে আটকে গেল। করাচিতে হালিমার থাকার ঠাঁই নেই, আত্মীয়ের ছোট্ট ঘরে সাময়িক ঠাঁই মিলেছে।
রাজনীতির নির্মমতা
সীমান্তের এপার-ওপার এখন বন্ধ। গুলি-বিনিময় চলছে, কূটনীতি ভেঙে পড়েছে, বাণিজ্য বন্ধ, উত্তেজনা চরমে। এ পর্যন্ত ভারতে থাকা প্রায় ৭৫০ পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানে থাকা ১ হাজার ভারতীয় নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরেছেন।
কিন্তু যারা ফিরতে পারেননি, অথবা ফিরেও বেঁচে নেই যাদের মধুর সম্পর্কগুলো, তাদের গল্পগুলো রাজনীতির ভাষায় লেখা হয় না, লেখা হয় চোখের জলে।
সূত্র: আল-জাজিরা
রাকিব