ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিরোপা মেসির আর্জেন্টিনার

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৮:৪৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২

শিরোপা মেসির আর্জেন্টিনার

স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসির সঙ্গে সতীর্থদের উল্লাস

সোনাফলা সাফল্যের জন্য কতদিনের সাধনা, হা-পিত্যেশ। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনা সেই ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ উপহার দেন আর্জেন্টিনাকে। এরপর গুনে গুনে তিন যুগ অতিবাহিত হয়। কিন্তু ধরা দিচ্ছিল না কাক্সিক্ষত সোনার ট্রফি। অবশেষে এ কালের আরেক জাদুকর লিওনেল মেসির জাদুকরী পারফরমেন্সে ভর করে ৩৬ বছর পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবে ভেসেছে আলবিসেলেস্তারা। রবিবার রাতে ২২তম বিশ্বকাপের নাটকীয়, উত্তেজনাপূর্ণ ও উপভোগ্য ফাইনালে ফ্রান্সকে ভাগ্যনির্ধারণী টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবে ভেসেছে আর্জেন্টিনা। কাতারের রাজধানী দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে নাটকীয়তায় ভরপুর ফাইনালের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকে। এরপর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। সেখানে দু’দল আরেকটি করে গোল করলে ১২০ মিনিটের খেলা ৩-৩ গোলে ড্র থেকে শেষ হয়। এরপর ভাগ্যনির্ধারণী টাইব্রেকারে শেষ হাসি হেসেছে বিশ্বব্যাপী
কোটি কোটি সমর্থকপুষ্ট ও ভালোবাসার দল আর্জেন্টিনা।
ফাইনালে ফ্রান্সের হয়ে ১২০ মিনিটে তিনটি গোলই করে রেকর্ডগড়া হ্যাটট্রিক করেন এমবাপে। পরে পেনাল্টি শূটআউটেও ফরাসিদের হয়ে প্রথম গোল করে ম্যাচে মোট চার গোল করার অনন্য কীর্তি গড়েন তিনি। কিন্তু সতীর্থদের ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতা হয়নি এমবাপের। অন্যদিকে ১২০ মিনিটে আর্জেন্টিনার হয়ে জোড়া গোল করেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। আলবিসেলেস্তাদের অপর গোলটি করেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। পরে পেনাল্টি শূটআউটেও গোল করেন মেসি। বিশ্বকাপের মুকুট পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি মধুর প্রতিশোধও নিয়েছে আর্জেন্টিনা। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে এই ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরেই বিদায় নিয়েছিল মেসির দল। সেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নও হয় ফরাসিরা। এবার সেই দলটিকেই ফাইনাল মহারণে জব্দ করে প্রতিশোধ নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে বিখ্যাত আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা। ২০১৪ বিশ্বকাপেও শিরোপার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেবার অতিরিক্ত সময়ে জার্মানির কাছে হেরে কাঁদতে হয়ছিল ফুটবলপাগল দেশটিকে। আট বছর পর আরেকবার ফাইনালে এসে আর আগের ভুল করেনি টিম আর্জেন্টিনা। নিজেদের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে হারের পর থেকেই সতর্ক থেকে গুটি গুটি পায়ে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে কোচ লিওনেল স্কালোনির দল।
স্বপ্নপূরণের এই পথ পরিক্রমায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। মূলত রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা ও সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকার উদ্ভাসিত নৈপুণ্যে ভর করেই শঙ্কা কাটিয়ে নকআউট রাউন্ডে পা রাখে আলবিসেলেস্তারা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রতিটি ম্যাচেই মেসি জাদু অব্যাহত থাকে। তেমনি তাকে যোগ্য সহায়তা করতে থাকেন তারকা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, তরুণ ফরোয়ার্ড জুলিয়ান আলভারেজ, মিডফিল্ডার রডরিগো ডি পল, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ারা। পুরো আসরে চোখ ধাঁধানো ধারাবাহিক পারফরমেন্স প্রদর্শন করা মেসি অনুমিতভাবই জিতে নিয়েছেন টুর্নামন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ড। ২০১৪ বিশ্বকাপেও তিনি সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। কিন্তু সেবার ফাইনালে হারের বেদনায় কাতর হতে হয়েছিল। এর ফলে ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দুই বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার অসামান্য রেকর্ড গড়েছেন মেসি। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলাসহ আরও একাধিক গৌরবময় রেকর্ড ঝুলিতে গেছে আর্জেন্টাইন মহাতারকার। চোখ ধাঁধানো নয়নাভিরাম ফুটবল খেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া আর্জেন্টিনা প্রাইজমানি হিসেবে পেয়েছে ৪২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আর রানার্সআপ ফ্রান্সের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
ফাইনাল মহারণে তরুপের তাস ডি মারিয়াকে নিয়ে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। চোট থাকায় তুখোড় এই তারকা বেশিরভাগ ম্যাচেই বাইরে ছিলেন। মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য তাকে খেলান কোচ লিওনেল স্কালোনি। কিন্তু ফাইনাল মহারণে আর্জেন্টিনার লাকি ম্যান হিসেবে খ্যাত ডি মারিয়াকে শুরুর একাদশে রাখেন কোচ। আর তাতেই ম্যাচের শুরু থেকে ফরাসিদের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। মাঝমাঠে ডি মারিয়ে ছিলেন রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। তাকে থামাতেই চোখ আর নাকের জল এক হয়ে যায় ফরাসি ফুটবলারদের। দারুণ ছন্দে খেলতে থাকা আর্জেন্টিনা ম্যাচের ২৩ মিনিটে অধিনায়ক মেসির পেনাল্টি গোলে এগিয়ে যায়। এ সময় ডি মারিয়াকে উসমান ডেম্বেলে ডি বক্সে ফেলে দিলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। ঠা-া মাথায় পা পায়ের নান্দনিক শটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে উল্লাসে ভাসান এলএমটেন (১-০)। পরে আরেক গোল করে বিশ্বকাপে সবমিলিয়ে খুদে জাদুকরের গোল হয়েছে ১৩টি। এক্ষেত্রে মেসি ছাড়িয়ে গেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলেকে। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার অসামান্য কীর্তি গড়েছেন মহানায়ক মেসি। কীর্তি আরও আছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে গোল করা ও করানো মিলিয়ে মোট ২১টি গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন মেসি। বিশ্বকাপে মেসি নিজে করেছেন ১৩ গোল, আর করিয়েছেন আরও ৮ গোল।
এগিয়ে যাওয়ার পর ব্যবধান দ্বিগুণ করতেও খুব বেশি সময় নেয়নি আর্জেন্টিনা। এবার পাল্টা আক্রমণ থেকে চোখ ধাঁধানো গোল করেন প্রথম গোলের কারিগর ডি মারিয়া। ৩৬ মিনিটের এই গোলটি ছিল আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত সংঘবদ্ধ আক্রমণের ফসল। এ সময় মাঝমাঠ থেকে মেসি দৃষ্টিনন্দন টোকায় বল বড়ান আলভারেজের দিকে। এরপর আলভারেজ বল বাড়ান সামনে এগিয়ে যাওয়া ম্যাক অ্যালিস্টারকে। তার পাসে বা পায়ের কোনাকুনি শটে চোখ ধাঁধানো গোল করেন ডি মারিয়া (২-০)। গোল করার পর কাঁদতে দেখা যায় অভিজ্ঞ এই ফুটবলারকে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপেও অসাধারণ খেলেছিলেন ডি মারিয়া। কিন্তু জার্মানির বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলতে পারেন নি চোটের কারণে। আর তাই আর্জেন্টিনাকেও ফাইনালে হেরে কাঁদতে হয়েছিল। সেই মারিয়ার এবারও চোট ছিল। কিন্তু ফাইনালে সব শঙ্কা দূর করে মাঠে নেমে অসাধারণ ফুটবল উপহার দেন। বড় ম্যাচের এই সুপারস্টার এর আগে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইতালির বিরুদ্ধে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মহারণেও গোল করেছিলেন।
অবাক করা বিষয়, শুধু ম্যাচের প্রথমার্ধেই নয় ৭৫ মিনিট পর্যন্ত ফ্রান্স আর্জেন্টিনার গোলপোস্ট লক্ষ্য করে একটা শটও নিতে পারেনি। আর্জেন্টিনার জমজমাট রক্ষণভাগ কিছুতেই ভাঙতে পারছিলেন না এমবাপে, গ্রিজম্যানরা। ফরোয়ার্ড জিরুডকে তো ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম প্রথমার্ধেই তুলে নেন। গ্রিজম্যানকেও বিরতির পর তুলে নেন তিনি। যখন প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিলেন ম্যাচ জিততে চলেছে আর্জেন্টিনা ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আসেন সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপে। ৮০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে ফরাসিদের ম্যাচে ফেরান এই গতিদানব। অথচ গোল করার আগ মুহূর্তে পর্যন্ত এমবাপে ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। জিরুড-গ্রিজম্যানকে তুলে নিলেও বদলি হিসেবে নামা ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা দুর্দান্ত খেলেন। বিশেষ করে মাঠে নেমে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ফুটবল খেলেন কোলো মুয়ানি। ৭৯ মিনিটে দারুণ  নৈপুণ্যে আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার ওটামেন্ডিকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে ফেলে দেন ওটামেন্ডি। পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। পরের মিনিটে সফল পেনাল্টি শটে গোল করেন এমবাপে (২-১)।
৮০ মিনিটের এই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই আবার গোল হজম করে বসে আর্জেন্টিনা। এবারও নায়ক সেই এমবাপে। তরুণ থুরামের ডিফেন্সচেরা পাস থেকে চলতি বলে আর্জেন্টিনার জাল কাঁপান এমবাপে (২-২)। বাকি সময়ে ফ্রান্স জয়সূচক গোলের সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ২-২ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। এরপর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। এই সময়েও আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণে ম্যাচ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। দলের বিপর্যয়ের মুহূর্তে আরেকবার জ্বলে ওঠেন আর্জেন্টাইন মহানায়ক। ১০৯ মিনিটে আর্জেন্টিনার একটি প্রচেষ্টা ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস অসাধারণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে দারুণ শটে গোল করেন মেসি (৩-২)। এ সময় ফ্রান্সের একজন ডিফেন্ডার বল ফেরালেও বল গোললাইন অতিক্রম করায় গোল পায় আর্জেন্টিনা।
আরেকবার পিছিয়ে পড়ার পরও দমে যায়নি অদম্য ফরাসিরা। ১১৮ মিনিটে তাদের একটি জোরালো শট আর্জেন্টিনার একজন ডিফেন্ডারের হাতে লাগলে ফের পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। সফল স্পট কিকে এমবাপে গোল করে ফের সমতায় ফেরান ফ্রান্সকে (৩-৩)। এই গোল করে বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার অনন্য কীর্তিগাথা রচনা করেন এমবাপে। সেই সঙ্গে এবার ৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলের অ্যাওয়ার্ড গোল্ডেন বুট জিতেছেন এ কালের কালো মানিক। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সহ ১২০ মিনিটের খেলা ৩-৩ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। এরপর ম্যাচ গড়ায় ভাগ্যনির্ধারণী পেনাল্টি শূটআউটে। এখানে আরেকবার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজেদের বীরত্বে ৪-২ গোলের অবিস্মরণীয় জয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। পেনাল্টি শূটআউটে ফ্রান্সের হয়ে এমবাপে প্রথম গোল করলেও কিংসলে কোম্যানের নেয়া ফরাসিদের দ্বিতীয় শট ফিরিয়ে দেন মার্টিনেজ। ফ্রান্সের হয়ে তিন নম্বর শট নিতে আসা চুয়ামেনির শট বাইরে দিয়ে যায়। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম তিন শটেই গোল করেন যথাক্রমে অধিনায়ক মেসি, পাওলো দিবালা ও লিয়েন্দ্রো প্যারাডেস। ফ্রান্সের হয়ে কোলো মুয়ানি চার নম্বর শটে গোল করলেও আর্জেন্টিনার হয়ে চতুর্থ শটে ডিফেন্ডার গঞ্জালে মনটিয়েল গোল করে আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত করেন। দু’দলের প্রথম চারটি করে শটেই জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় পঞ্চম শট নেয়ার আর প্রয়োজন হয়নি।
এবারসহ ছয়বার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা। এর আগের পাঁচ ফাইনালে দুইবার জিতলেও তিনবার হেরেছে ম্যারাডোনার দেশ। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা। যেখানে উরুগুয়ের কাছে ৪-২ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে হল্যান্ডকে ৩-১ গোলে ও ১৯৮৬ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। এরপর ১৯৯০ ও ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় ম্যারাডোনার দেশের। কিন্তু এবার আর ফাইনালে হারের বেদনায় পুড়তে হয়নি মেসি, মার্টিনেজদের। মরুর বুকে ঝড় তুলে নিজেদের ইতিহাসে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ের গৌরবে ভেসেছে আর্জেন্টিনা।
এর ফলে আর্জেন্টিনা এখন বিশ্বকাপ জয়ের হিসেবে বিশ্ব ফুটবলের চতুর্থ সেরা সাফল্যের দেশ। একমাত্র আর্জেন্টিনাই তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছে। তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের নজির আর কারো নেই। সর্বোচ্চ ৫টি বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল, ৪ বার করে এই স্বাদ পেয়েছে জার্মানি ও ইতালি। এর পরেই ৩টি সোনার ট্রফি জিতে আর্জেন্টাইনদের অবস্থান। ২ বার করে বিশ্বকাপ জিতেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে ও এবার ফাইনালে হারা ফ্রান্স। ১ বার করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইংল্যান্ড ও স্পেন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত হওয়া ২২টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৮টি দেশ। বিশ্বকাপের ফাইনালে সবচেয়ে বেশিবার হারা দেশ জার্মানি। চারবার বিশ্বচাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের পাওয়ার হাউসরা ফাইনালেও হেরেছে সামান চারবার। অর্থাৎ ১৯৬৬, ১৯৮২, ১৯৮৬ ও ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে হার মানে জার্মানি। অন্যদিকে ইতিহাসের তৃতীয় দল হিসেবে টানা দুইবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার হাতছানি ছিল ফ্রান্সের সামনে। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে ইতালি এবং ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে পরপর দুইবার বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। কিন্তু এবার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ইতালি ও ব্রাজিলের পাশে নাম লেখাতে ব্যর্থ হয়েছে ফরাসিরা।
আট বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে হারলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমূলে পাল্টে গেছে আর্জেন্টিনা। বিশেষ করে ২০২১ সালে ২৮ বছর পর প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা  (কোপা আমেরিকা) জয়ের মধ্য দিয়ে নান্দনিক ছন্দে আছে আলবিসেলেস্তারা। এর মধ্যে আবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমার শিরোপাও জিতেছে তারা। দলের প্রাণভোমরা মেসির নেতৃত্বে নান্দনিক ছন্দে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে আসে কোচ স্কালোনির দল। ফরাসিদের বিরুদ্ধে ফাইনাল মহারণে জানবাজি রেখে নিজেদের সেরা পারফরমেন্স উপহার দেন আলভারেজ, মার্টিনেজ, ডি পলরা। ৩৬ বছর আগে তখনকার বিস্ময় বালক দিয়াগো ম্যারাডোনা সেই যে বিশ্বজয় করিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে, তারপর থেকে দেশটির ভাগ্যে শুধুই হতাশা ভর করেছিল। সমর্থকদের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য ছিল। ১৯৯০ সালে নিজে কেঁদে ও ১৯৯৪ সালে সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছেন ম্যারাডোনা। ২০১০ সালে ফের এসেছিলেন মুকুট জয়ের লক্ষ্যে। কিন্তু মেসি, তেভেজদের কোচ হয়ে দেখা পাননি সাফল্যের।
২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে নিশ্বাস দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছিল লিওনেল মেসির দল। কিন্তু ফাইনাল মহারণে ফের জার্মানির কাছে হেরে হৃদয় ভাঙে ফুটবলপাগল দেশটির। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও সঙ্গী হয় ব্যর্থতা। অবশেষে এবার ধারাবাহিক ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে এসে সেই ফরাসিদের হারিয়েই বিশ্বজয়ের আনন্দে মেতেছে আর্জেন্টিনা। ফাইনালের ধ্রুপদী ফুটবলশৈলী বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ টিভি পর্দায় উপভোগ করেছেন। বলাইবাহুল্য এসব ভক্ত-সমর্থকের প্রায় সবাই আর্জেন্টিনার সমর্থক। তাইতো ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে মধ্যরাতেও লাল-সবুজের দেশের আনাচে কানাচে মেসিদের বিজয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। মূলত ছিয়াশি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার জাদুকরী পারফরমেন্সের কারণেই বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক বেড়ে যায় বহুগুণে। দীর্ঘদিন হাহাকার থাকলেও এবার আরেক জাদুকর মেসি, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ও গোলরক্ষক মার্টিনেজের বীরত্বে বিশ্বসেরার মুকুট পুনরুদ্ধার করেছে আর্জেন্টিনা। তাইতো মরুর বুকে জয় নিশ্চিত করা গোল করার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বাংলাদেশ আনন্দ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। শুধু বাংলাদেশ নয়; মেসি-মারিয়াদের নিয়ে গোটা দুনিয়াতেই চলছে প্রশংসার স্রোত।

 

সম্পর্কিত বিষয়:

×