রিফাত-বিন-ত্বহা ॥ এবার এমপি হবার স্বপ্নে বিভোর মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনের মূল হোতা নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকত-উল-জিহাদের নেপথ্য নায়ক বর্তমানে বিদেশে পলাতক চারদলীয় জোটের সাবেক সেই এমপি মুফতি শহীদুল ইসলাম। এই জঙ্গী গডফাদারের রয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী কানেকশন। আইএসআইয়ের বিশ্বস্ত দেশীয় এজেন্ট হিসেবে পরিচিত এই জঙ্গী নেতার বিরুদ্ধে দেশের সকল বোমা হামলার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উগ্র- মৌলবাদী জঙ্গী অর্থের যোগানদাতা হিসেবে অভিযুক্ত এই মুফতি শহীদুল ইসলাম আবারও বিশেষ মিশন নিয়ে বাপ-বেটা ভোটে দাঁড়িয়েছেন। মুফতি শহিদুল ইসলাম নড়াইল-২ আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোননীত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মর্তুজা নির্বাচন করছেন।
এদিকে একই আসনে তার ছেলে মুফতি তালহা ইসলামও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। মুফতি শহিদুল যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়লে তার ছেলে তালহা এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। এই আসন থেকে বিএনপি ও জোটের অপর দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপি মনোনীত শরীফ কাসাফুদ্দোজা কাফী, ২০ দলীয় জোটের শরিক এনপিপির চেয়ারম্যান এ জেড এম ড. ফরিদুজ্জামান মুফতি শহিদুলকে পুনরায় মনোনয়ন না দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। সচেতন মহলের আশঙ্কা এই মৌলবাদী ব্যক্তি যদি আবার নড়াইলের নির্বাচনী মাঠে আসে তাহলে এখানে জঙ্গী তৎপরতা শুরু হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতা জানান, গত ২২ নবেম্বর ঢাকায় খুলনা বিভাগের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাতকারের সময় দেখা যায় এ আসন থেকে মুফতি শহিদুল ইসলাম বিএনপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
জানা গেছে, ২০০১ সালের ৮ম সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিপক্ষে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আলোচনায় আসে মুফতি শহীদুল ইসলাম। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা জয়লাভ করেন। জঙ্গী কানেকশনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত মুফতি শহিদুল মনোনয়ন পেতে পারেন এ নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠসহ পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হলে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলেও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের পর পরই জঙ্গী তৎপরতা ও এ কাজে অর্থের যোগানদাতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘিœতসহ বিভিন্ন কারণে মুফতি শহিদুল যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। পরে দুদক তার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করে এবং একটি মামলায় ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি এমপি থাকা অবস্থায় ঢাকায় তার কন্যা খাদিজা ও এক পাকিস্তানী মহিলাকে ঢাকার কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির একটি ফ্ল্যাট থেকে র্যাব আসল ও নকল ১১ লাখ টাকা ও ডলার এবং কয়েকটি পাসপোর্ট আটক করে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে র্যাব-পুলিশের হাতে আটক জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জেএমবির সামরিক প্রধান আতাউর রহমান সানী গ্রেফতারের পর সে তথ্য দেয় জেএমবির অর্থ লেনদেন এবং জঙ্গীদের সঙ্গে এমপি শহিদুলের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০০৭ সালের ১৬মে জঙ্গী তৎপরতা ও আর্থিক সহযোগিতার অভিযোগে মুফতি শহিদুলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ও মামাত ভগ্নিপতি আফগানিস্তানে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করা খেলাফত মজলিসের শূরা সদস্য মাওলানা এমরানুজ্জামানকে যৌথবাহিনী গ্রেফতার করে। জানা গেছে, তিনি পাকিস্তান, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে থাকেন।
কে এই মুফতি শহীদুল
নানা কারণে আলোচিত মুফতি শহিদুলের বাড়ি নড়াইলের চর করফা গ্রামে। তার ডাক নাম মিলনুন। বর্তমানে বসবাস করেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে। গোপালগঞ্জের গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। সেখান থেকে দাখিল পাস করার পর চলে যান ভারতে। ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে পরবর্তীতে পাকিস্তানে পড়াশোনা করেন। সর্বশেষ মদিনা থেকে মুফতি ডিগ্রী লাভ করেন। আফগানিস্তান ও কাশ্মীর যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন। ওই যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শিতার কারণে তাকে বোমা শহিদুল হিসেবে উপাধি দেয় সহযোদ্ধারা। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনার নিরলায় কাদিয়ানী মসজিদে শক্তিশালী বোমা হামলায় ১০ নিরীহ মুসল্লি নিহত হয় ও ৩০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের আরেকটি মামলা দায়ের করে। কোতোয়ালি থানার মামলা নং-১২, তারিখ-৯/১০/৯৯, ধারা-৩০(৩৪) দঃবি, এফ,আই,আর নং-১০৮, তারিখ-২৩-৮-২০০১, ধারা-৩০২(৩৪)। এছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্য (৩) ধারায়, যার এফ,আই,আর নং-১০৯, তারিখ-২৩-৮-২০০১ উভয় মামলায় মুফতি শহিদুল ইসলামকে ১নং আসামি উল্লেখ করা হলেও জোট সরকারের এমপি হওয়ার সুবাদে প্রভাব বিস্তার করে মামলা দুটিতে শেষ পর্যন্ত ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার মামলা দুটি পুনঃতদন্ত করায় বিপাকে পড়ে মুফতি শহিদুল ইসলাম । এছাড়া ঢাকার জান্নাতুল ফেরদৌস জামে মসজিদে শক্তিশালী বোমা রাখার ঘটনায় মুফতি শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।
১৯৯৯ সালের ৮ আগস্ট অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা ভবনে একটি ব্রিফকেস রেখে যায়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক টিম ব্রিফকেসটির ভেতরে রক্ষিত মাইনটি উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ব্যাপারে মুফতি মোঃ শহিদুল ইসলামকে ১ নম্বর আসামি করে মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ বাদী হয়। রমনা থানায় মামলা নং-৩২, তারিখ-০১/১০/৯৯, বিষ্ফোরক আইন। এছাড়া এই ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা ছাড়াও জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে রমনা থানায় আরও একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ওই শহিদুল ইসলামসহ তার সঙ্গীদের গ্রেফতার করে রমনা থানা পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর যৌথবাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ সেলে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে শক্তিশালী গ্রেনেড হামলার বিবরণ দিয়ে শিকার করেন যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে ৪ দলীয় জোটের এমপি নড়াইল-২ আসনের এমপি মুফতি শহিদুল ইসলামসহ কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন মুফতি হান্নান।
আন্তর্জাতিক উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনের যেসব নেতা ঢাকার আল-মারকাজুলের গেস্ট হাউজ এবং নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা লক্ষীপাশার আল-নূর কমপ্লেক্সে অবস্থান করত এবং ২০০১ সাল থেকে জোট সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত নড়াইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুফতি শহিদুল ইসলামের সঙ্গে প্রকাশ্যে চলাফেরা করেছে। ইসলামী মহাসম্মেলনের নামে বিশ্বের ২২টি দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গী নেতাদের এনে লক্ষ্মীপাশা মোল্লার মাঠে ২০০৩ ও ২০০৪ সালের ১১ ও ১২ মার্চ দুটি সম্মেলন করা হয়েছে।