চরিত্র
নির্দেশক (বয়স ৩০)
কাঞ্চু (একই বয়সের)
ছেলে (বয়স ২২ থেকে ২৫)
মেয়ে (বয়স ১৮ থেকে ২০)
পুরুষ (ছেলের বয়সের)
মহিলা (মেয়ের বয়সের)
প্রথম ওয়েটার (বয়স ৩০ থেকে ৩৫)
দ্বিতীয় ওয়েটার (একই বয়সের)
স্বামী (বয়স ৪৫ থেকে ৫০)
স্ত্রী (বয়স ৪০ থেকে ৪৫)
প্রথম অংক
প্রথম দৃশ্য
সময় বিকেল। নাটক শুরুর নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে পর্দা উঠবে (যদি প্রোসেনিয়াম মঞ্চে নাটকটি করা হয়)।
নাটক শুরুর আগে থেকেই সঙ্গীত শোনা যাবে। অভিজাত রেস্টুরেন্টের জন্য মানানসই কোন বিদেশি যন্ত্রসঙ্গীত।
আলোÑ মঞ্চে ঝুলন্ত ডোম বা ঝাড়বাতিগুলো জ্বলছে। অভিজাত রেস্টুরেন্টে যেমন বৈচিত্র্যময় আলোয় সজ্জা, তেমনই। তবে অবছা। মূল নাটক শুরুর আগে মঞ্চে ঝাড়বাতিগুলো, কাউন্টার টেবিল ও কাস্টমারদের টেবিলগুলোর ওপর আলো জ্বলতে থাকবে।
মঞ্চÑ মধ্যমঞ্চে দেড়/দু’ফুট উঁচু চৌকোণো প্ল্যাটফর্ম। তার ওপরে টেবিল ও পাশাপাশি দুটি চেয়ার। টেবিলে একটি এ্যাস্ট্রে। তার পেছনে একপাশে গীটারিস্টের জন্য টুল। মধ্যমঞ্চের একপাশে কাউন্টার টেবিল। সম্মুখমঞ্চের একদিকে নির্দেশকের রিভলভিং চেয়ার। অপরদিকে দুটি চেয়ারসহ একটি টেবিল খালি থাকবে। (দ্বিতীয় অংকে পুরুষ ও মহিলার জন্য) মঞ্চের তিনপাশে কাস্টমারদের চেয়ার টেবিল। প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি একটি টেবিল খালি থাকবে দ্বিতীয় অংকে স্বামী স্ত্রীর জন্য। কাউন্টার টেবিলে নিরাসক্ত মনে বসে আছে কাঞ্চু ম-ল। কানের ভেতর কাঠি দিয়ে চুলকানো তার অভ্যাস। দুজন ওয়েটার কাস্টমারদের কাছ থেকে অর্ডার নিচ্ছে ও খাবার পরিবেশন করছে।
পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হবার পর মঞ্চে প্রোডাকশন লাইট জ্বলবে। পর মুহূর্তেই প্রবেশ করে নির্দেশক। (তার আসন যেদিকে সেই দিক থেকে।) সে ঘুরে ঘুরে রেস্টুরেন্টের এদিক ওদিক থেকে মঞ্চের আলোগুলো দেখে নেয়। চোখে মুখে সন্তোষের ভাব। অতঃপর এগিয়ে আসে সম্মুখ মঞ্চের মধ্যখানে।
নির্দেশক : সমাগত সুধী দর্শকবৃন্দ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। (বাও করে) রেস্টুরেন্টের ভেতরে নাটক। এই যে ব্যাপারটা, মানে রেস্টেুরেন্টে ড্রামা, এ দেশে নতুন। বিদেশে অবশ্য পুরোনো। আমি যদিও দেখিনি। শুনেছি। আর শুনেই (অহঙ্কার মিশ্রিত হাসিতে) আমার ইনটুইশন তো প্রখর আর ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টিও প্রচুরÑ অতএব শুনেই আমি এ ধরনের নাট্যকর্ম চালু করার আয়োজন করেছি। আপনারা যারা এখানে এই সময়ে এসেছেন। এদিকে চাÑটাও খাবেন, আর ওদিকে ফাও হিসেবে নাটকও দেখবেনÑ বেশ মজার; উপরি পাওনা কিন্তু। এখন একটি ব্যাপার আমাদের দেশে যুগান্তকারী, আমাদের দেশের নাট্য আন্দোলনে বিপ্লব। (বেশ জোর দিয়ে) আমি বলতে চাই, এ বিপ্লবের সূচনা আমারি হাতে।
কাঞ্চু : বললেই হলো আর যেসব নাট্যদল আছে, তারা শুনলে তো খেপে যাবে।
নির্দেশক : (কাঞ্চুর দিকে তাকিয়ে) খেপবে না ছাই। আর ক’দিন পর যখন ওরা আমাকে ফলো করবে তখন দেখিস। (কাঞ্চুর প্রতি আর কোনো গুরুত্ব না দিয়ে) যে যাই বলুক, এর সমস্ত ক্রেডিট আমার। এর জন্য নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে আমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে, থাকতেই হবে। (হাসি হাসি মুখে গলার টাই নাড়া চাড়া করে)
আজকে শুভ উদ্বোধন। আপনার তো জানেনই, রেস্টেুরেন্টের নাম ‘এলেবেলে’। এলেবেলে রেস্টুরেন্টের প্রথম নাট্যানুষ্ঠান বলেই নাটকটির নামও দেয়া হয়েছে ‘এলেবেলে’। নাটকটি আমারি লেখা, আমারি পরিচালনা। পরিচালনা শব্দটা এখন পুরোনো হয়ে গেছে। সেজন্য আর সবাই নির্দেশক কথাটি ব্যবহার করে। আর তাই আমিও... এভাবে বলাটাই ভালো; রচনা ও নির্দেশনা আবু আলি মিরধা, বিএ হনস, এমএ থার্ড ক্লাস, ঢাক, মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়Ñ অর্থাৎ আমার।
আর কিনা, এই রেস্টুরেন্টের অপর অংশীদার, যদিও সে এখন পর্যন্ত একটি পয়সাও দেয়নি, বরং চান্স পেলেই দু’পয়সা খসিয়ে নিচ্ছেÑ (কাঞ্চুর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে) আমার বন্ধু জনাব কাঞ্চু ম-ল বিএ; তাকে একটা পোস্ট না দিলে অবিচার হয়, সে জন্যে ফিলিম নাটক এসবের তো একজন প্রডিউসার বা প্রযোজক থাকে, তা ওই প্রডিউসারের পদটা আমি তাকে দিয়েছি। আর সে নিজেই যে দায়িত্বটা আমার কাছ থেকে নিয়েছে। আমার বোঝার আগেই, সেটা হচ্ছে এই রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ারের। (কাঞ্চুকে) এদিকে আয় দেখি।
কাঞ্চু : আমাকে আবার কেন? (বলতে বলতে এগিয়ে আসে এবং সম্মুখ মঞ্চ থেকে একটি চেয়ার নিয়ে নির্দেশকের কাছাকাছি বসে পড়ে।)
নির্দেশক : আজকে প্রথম দিন, মানে শুভ উদ্বোধন কিনা, সে জন্যেই তোকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। না হলে কি আর...। থাকগে। (দর্শকদের উদ্দেশে) নাটক এক্ষুণি শুরু হবে। শুরুর আগে একটা কথা বলে নেয়া দরকার। কথাটা হচ্ছে গিয়ে... এই নাটকে... একটু ঘাপলা হয়ে গেছে।
কাঞ্চু : তুই যেখানে সেখানে তো হবেই।
নির্দেশক : থাম তুই। ...একে ঠিক ঘাপলা বলা উচিত হবে না। বরং বলা যায়, বরং এটাকে একটা... ওই যে কি বলে... এক্সপেরিমেন্ট, নিরীক্ষামূলক ব্যাপার-স্যাপার বলে চালানো যেতে পারে।
কাঞ্চু : না পারলেই বড়ো বড়ো কথা।
নির্দেশক : (কাঞ্চুকে উপেক্ষা করে) নাটকটার রিহার্সাল ঠিক যেমন হওয়া দরকার তেমনটি হয়নি। মাত্র... থাকগে, সেটা আপনাদের না জানলেও চলবে। আসল কথা ঠিকমতো হয়নি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা নাটকটি লেখাই হয়নি। আইডিয়া বলুন, ডায়লগ বলুন, এ্যাকশন, এক্সপ্রেশনÑ সবকিছু মাথার মধ্যে জড়ো হয়ে আছে, শুধু লিখে ফেললেই চলতো। কিন্তু সত্যি বলতে কি, হয়নি (কাঞ্চুর দিকে তাকিয়ে নিয়ে)Ñ আমার এই বন্ধুর জন্যে।
কাঞ্চু : (রেগে) কি?
নির্দেশক : তুই-ই তো। এতো তাড়াহুড়ো না করলে...
কাঞ্চু : করবো না তো কি। (চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রতি) বুঝলেন, রেস্টুরেন্ট কেনা হয়েছে সেই কবে। তাও আবার কি করে খুলবেন।... এটি ছিলো আমাদের আরেক বন্ধুর রেস্টুরেন্ট। সে চালাতে না পেরে আমাদের কাছে বেঁচে দিয়ে ওয়েজ আর্নিং স্কীমে একই সঙ্গে বেবি ফুড আর ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের ব্যবসায় নেমে গেলো। তার কাছ থেকে কেনা হয়েছে সেই দু’মাস। সে কিনা এর মধ্যেই অনেক বানিয়ে ফেলেছে। আর আমরা? (নির্দেশককে দেখিয়ে) ইনি তাল তুললেন যে, নাটক রেডি হলে পর রেস্টুরেন্ট ওপেন করা হবে। এতগুলো টাকা একেবারে ফালতু ফেলে রাখা যায়, আপনারাই বলুন।
নির্দেশক : তোর কি? তোর তো টাকা নয়। সব টাকা আমার। এ ক’বছর মেরে কেটে লুটে পুটে যা গুজিয়েছিলাম পুরোটাই ইনভেস্ট করেছি এতে। এর মালিক আমি।
কাঞ্চু : তাতে কি হয়েছে?
নির্দেশক : কি হয়েছে মানে। তোর দরদ কার জন্যেÑ আমার জন্যে, না এই রেস্টুরেন্টের জন্য।
কাঞ্চু : বড়ো কঠিন প্রশ্ন।
নির্দেশক : শুনে রাখÑ তোর দরদ থাকতে হবে আমার জন্যে। কারণ আমার জন্যে দরদ মানেই রেস্টেুরেন্টের জন্যে দরদ।
কাঞ্চু : তুই দেখছি লিডারদের মতো কথা বলছিসÑ আমাকে ভালোবাসা মানেই দেশকে ভালোবাসা।
নির্দেশক : লিডাররা ঠিকই বলে।
কাঞ্চু : তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি তোর বন্ধু। আমার জন্যেও তোর দরদ থাকতে হবে।
নির্দেশক : সেটা খুব ইম্পর্টেন্ট নয়।
কাঞ্চু : (কিঞ্চিত ভুরু কুছকে) ও। তবে (বেশ জোর দিয়ে) ক্যাশ মেনেজমেন্ট কিন্তু আমার হাতে।
নির্দেশক : (একটু টেসে যায় যেন) ও। (নিচু গলায়) ঠিক আছে থাম। লোকজনের সামনে নিজেদের মধ্যে... (কাঞ্চু বসে পড়ে) আফটার অল, আমরাই তো। (দর্শকদের) শুনুন। ব্যাপারটা হলো গিয়ে নাটক লেখা না হলেও যেভাবে আমি নাটকটা নামাচ্ছি, তা কি বলবোÑ অভিনব। কুশীলবদের আমি পর পর ঘটনাগুলো মানে সিকোয়েন্সগুলো, ক্লাইম্যাক্স, এ্যাকশন সবকিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছি। তারাও ঠিক ঠিক বুঝে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সমস্ত সিকোয়েন্সগুলোর কিছু ডায়ালগও তাদের দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা সেগুলো মুখস্ত করে নিয়েছে। কাঞ্চু তো এ সবের মাহাত্ম্য ঠিক বোঝে নাÑ
কাঞ্চু : কি বললি?
নির্দেশক : ঠিকই তো। বুঝলে কি আর তিনবার বিএ ফেল করতিস।
কাঞ্চু : (দমে যায়) তুই লোকজনের সামনে এভাবে...
নির্দেশক : দর্শকেরা জানে।
কাঞ্চু : দর্শক নয়, খদ্দের।
নির্দেশক : ওই হলো। তারা জানে তুই বিএ পাস। যদিও ১৯৭২ সালে? (কাঞ্চু ক্ষুণœ মনে উঠে কাউন্টার টেবিলে বসে) সে যাকগে। কথা হলো...
প্রথম খদ্দের : এতো কথা রেখে নাটক শুরু করুন।
নির্দেশক : নাটকের জন্যেই তো বলতে হচ্ছে, যাকে বলে ভূমিকা। আপনারা যাতে আমার এ নাটকের স্পিরিট ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারেন সে জন্যেই কথাগুলো আমাকে বলতে হচ্ছে।
২য় খদ্দের : তাহলে সংক্ষেপে সেরে দিন।
নির্দেশক : আচ্ছা, আচ্ছা, সংক্ষেপেই সেরে দেবো।... কথা হলো, আমার নাটকে এ্যাকটর-এ্যাকট্র্রেস মাত্র দু’জনÑ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। দু’জনেই বেশ অভিজ্ঞ আর তুখোড়। তাদের তো সিকোয়েন্স এ্যাকশন এসব বোজানো হয়েছে, তবুও আমি আরেকটা কায়দা করেছি। কারণ ওদের চেয়ে আমার পজিশন অন্যরকম। আমি ছোটবেলায় ইংরেজি স্কুলে পড়ার সময় একটা নাটকে মৃত সৈনিকের ভূমিকয় অভিনয় করে খুবই সুনাম অর্জন করেছিলাম। আর এদিকে পত্রপত্রিকায় যে সব নাট্য সমালোচনা বেরোয় সে সব পড়ে যেমন জ্ঞানলাভ করেছি, তেমনি নাটকের প্রতি আমার ইন্টারেস্টও বেড়ে গেছেÑ ফলে ওদের চেয়ে আমি শ্রেষ্ঠ। সে জন্যেই ঠিক করেছি, অভিনয় চলাকালে আমি এ্যাকশনগুলো বলে যেতে থাকবো, ডিকটেট করতে থাকবো, ওরা সেই মতো অভিনয় করে যাবে। এ দুজন ছাড়া আরো একজন আছে, নতুনত্বের কারণে তাকে রেখেছি, সে হচ্ছে (একটু বেশি জোর দিয়ে) ওয়েটার।
প্রথম ওয়েটার : (কোনো খরিদ্দারের টেবিলে ব্যস্ত) ইয়েস স্যার।
নির্দেশক : না, তোমাকে নয়।... আরো একজন আছে। অভিনেতা নয়, মিউজিশিয়ান বা সঙ্গীত পরিচালক। সে একজন কামেল গীটারিস্ট। তাকেও সব সিকোয়েন্স বোঝানো হয়েছে। সে এফেস্ট মিউজিক দেবে। দরকার হলে আমি তাকেও নির্দেশ দেবো।... যাই বলুন, এটাও কিন্তু একটা এক্সপেরিমেন্ট, সফলতার যাত্রাপথে এর মূল্য...।
কাঞ্চু : ফলেই পরিচয়।
নির্দেশক : (কাঞ্চুর প্রতি একবার ভ্রƒক্ষেপ করে, দর্শকদের উদ্দেশে) আসল কথা হচ্ছে, আপনারা তো এটা জানেনই যে, নাটকের নীতি হচ্ছে নির্দেশক যা ইচ্ছে করবে, যা বলবে, অভিনেতারা তা-ই মেনে নেবে, মানতে বাধ্য। অর্থাৎ কিনা নাটকের এথিক্স অনুযায়ী ডিরেক্টর মানেই ডিকটেটর, সর্বময় অধিকর্তা। সুতরাং আমার নির্দেশই চরম এবং পরম।
(কাঞ্চু খিক্খিক্ করে হেসে উঠে। নির্দেশক রাগত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।)... আমি এই নাটকের কুশীলবদের যা নির্দেশ দিয়ে রেখেছি এবং যেমন যেমন দেবো, তারা তাই বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করে অভিনয় করে যাবে। আমার মহৎ আইডিয়াকে সুন্দরভাবে রূপায়িত করবে। তাতে যদি প্রোডাকশন গোল্লায় যায় যাক, আমি জানি তা যেতে পারে না। কিন্তু নাটকের এথিক্স আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কারণ আমি লক্ষ্য করেছি যে, এ দেশের নাট্যকর্মে নির্দেশকের এই ভূমিকা আজ পর্যন্ত কোন গুরুত্ব পায়নি। এদিক থেকে এটাও আমার কৃতিত্ব, আমাদের নাটকের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। কেউ যদি না লেখে, কেউ ঠিকমতো লিখতে পারবেও না, আমি নিজেই লিখবো, বেনামে লিখবো। (কাঞ্চু প্রচ- উৎসাহে হাততালি দেয়।)... (কাঞ্চুর উদ্দেশে) ধন্যবাদ। (দর্শকদের উদ্দেশে, বাও করে) ধন্যবাদ।
মঞ্চ সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়। ঝুলন্ত ডোমগুলোও নিভে যাবে।
দশ সেকেন্ড অন্ধকার ও নীরবতা। এই সময়ের মধ্যে মিউজিশিয়ান এসে তার নির্ধারিত টুলে বসবে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
সম্মুখ মঞ্চের পুরুষ মহিলার জন্য নির্দিষ্ট টেবিল ছাড়া অন্যান্য সমস্ত আলো জ্বলে উঠবে।
দেখা যাবে নির্দেশক সম্মুখ মঞ্চের মাঝখানে মিউজিক ডিরেক্ট করার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে। কাঞ্চু ম-ল কাউন্টার টেবিলে কিছু একটা করছে। মিউজিশিয়ান গীটারে হাত লাগিয়ে বসে আছে হুকুমের অপেক্ষায়। আলো জ্বলতেইÑ
নির্দেশক : মিউজিক। (মিউজিশিয়ান প্রারম্ভিক সঙ্গীত বাজাতে থাকে। নির্দেশক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বা মাঝে মাঝে মিউজিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দোলাতে থাকে যেন অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করছে। কিছু পরে দর্শকদের দিকে ফিরে) নাটক শুরু হচ্ছে। (যেয়ে নিজ আসনে বসে। চারদিকে দেখে।) মেয়েটি আসলো।
(নির্দেশকের অপর দিক থেকে মেয়ের প্রবেশ। পরনে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অতি আধুনিক হাল ফ্যাশনের পোশাক।) ঢুকেই দেখলো আর কেউ আসেনি। একটু ব্যথিত হলো। এগিয়ে চলেছে মঞ্চের দিকে। অর্থাৎ প্ল্যাটফর্মের দিকে।
মঞ্চের চেয়ারে বসার আগে ঘড়ি দেখলো। বসলো। কাঁধের ব্যাগটি টেবিলে রাখলো। বাইরের দিকে দেখলো। চোখ থেকে রোদ চশমা নামিয়ে রাখলো টেবিলে।
(ওয়েটার উঁকি দিয়ে মেয়েটি দেখছে, লক্ষ্য করে) ওয়েটার উঁকি দিয়ে দেখলো মেয়েটিকে। মেয়েটি ব্যাগ থেকে একটি বই নিয়ে পড়ার ভান করতে লাগলো। (বেশিক্ষণের বিরতি দিয়ে) ওয়েটার টেবিলে মেনু এন দিলো।
ওয়েটার মেনু দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় কাঞ্চু ওয়েটারকে ইশারা করে কিছু যেন বুঝিয়ে দেয়। নির্দেশক তা লক্ষ্য করে এবং বিরক্তি প্রকাশ করে। ওয়েটার ভিতরে চলে যায়।
মেয়েটি আবার ঘড়ি দেখলো। বিরক্তি আর ক্ষোভ তার চোখে মুখে। বাইরের দিকে দেখলো। অবশেষে বই পড়ার ভানে আবার নিবিষ্ট হলো। (ওয়েটার মেয়েটির বই পড়ার সময় এক গ্লাস পানি এনে টেবিলে রাখে। মেয়েটি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকায়। নির্দেশক ক্ষুব্ধ হয়ে কঠিন কণ্ঠে) ওয়েটার। (ওয়েটার থমকে দাঁড়ায়) এটা কি হচ্ছে?
ওয়েটার : আমার কি দোষ (কাঞ্চুকে দেখিয়ে) উনিই তো...।
কাঞ্চু : এমন একজন মারকাটারি খদ্দের এসে বসলো অর্ডার-ফর্ডার...
নির্দেশক : যখন সময় হবে তখন ঠিকই দেবে। তোকে মাতবরী করতে হবে না। ওয়েটার, পানি নিয়ে যাও? (ওয়েটার পানি নিয়ে চলে যায়।)
মেয়ে : (দাঁড়িয়ে) এটা কি নাটকের মধ্যে?
নির্দেশক : না না, তা কেন?
মেয়ে : তাহলে...
নির্দেশক : ওটা কিছু নয়, এ্যাকশন। (সঙ্গে সঙ্গে মিউজিশিয়ান গীটার বাাজনো শুরু করে) তোমাকে আবার মিউজিক দিতে বললো কে?
মিউজিশিয়ান : (থামিয়ে, উঠে দাঁড়ায়) আমি তাহলে ভুল বুঝেছিলাম।
কিন্তু স্যার... (মেয়ে ততোক্ষণে বসে পড়ে।)
নির্দেশক : কি?
মিউজিশিয়ান : ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে বলবো স্যার।
নির্দেশক : নির্ভয়ে।
মিউজিশিয়ান : কোনো কোনো জায়গায় যদি স্যার দিয়ে ফেলি, তাহলে...
নির্দেশক : ঠিক আছে, তখন দেখা যাবে।
ছেলে : তার মাথায় ক্যাপ, পরনে ভদ্র পোশাক বড়সর গোঁফ ও জুলফি। বিস্মিতভাবে বলতে বলতে প্রবেশ করে। আলী সাহেবÑ
মেয়ে : হাই। (খুশিতে উঠে দাঁড়ায়। ছেলে তাকে হাত তুলে ইশারা করে।)
নির্দেশক : (চমকে দাঁড়িয়ে যায়, মেয়েকে) থামো থামো। (ছেলেকে) কি ব্যাপার।
ছেলে : এই যে আপনার আর মিউজিশিয়ানের কথাবার্তা, এগুলো কি নাটকে আছে?
নির্দেশক : হ্যাঁ।
ছেলে : কই আগে তো বলেননি।
নির্দেশক : ইমপ্রোভাইজেশন বুঝলে।
ছেলে : (না বুঝেই) ও। আমি তাহলে এখন কি করবো।
নির্দেশক : আবার কি। তোমার প্রবেশের কিউয়ের জন্যে অপেক্ষা করবে।
ছেলে : ওকে। (প্রস্থানের সময় মেয়েকে হাত তুলে ‘ওয়েভ’ করে।)
নির্দেশক : (মেয়েকে) রেডি। (মেয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। উভয়েই বসে পড়ে।)... মেয়েটি বই পড়ার ভান করতে থাকে।... বাইরের দিকে তাকায়। উঠে দাঁড়ায়। ঠিক করতে পারছে না, চলে যাবে কিনা। সামনের দিকে এগিয়ে আসে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকে।... ডায়ালগ।
মেয়ে : (এই সংলাপ চলাকালে নির্দেশক এক সময় সিগারেট ধরায়) আমি ওকে ভালোবাসি। না না, ভালোবাসা কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। ওকে আমার ভালো লাগে। তবে কিনা কিছুদিন থেকে ওই ভালোলাগাটা খুব বেশি বেশি মনে হচ্ছে। বড়ো তীব্রভাবে অনুভব করছি। এই তীব্রতাটুকুর নামই বোধকরি ভালোবাসা। তাই যদি হয়, তা হলে ওকে আমি ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। মাঝে মাঝে অবশ্য এমনও হয় একই সঙ্গে আরো দু’তিনজনের জন্যেও এই তীব্রতা আমার মনকে বিভ্রান্ত করে দেয়। এ ধরনের ভাব মনে জাগলেই আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমার কি মনে হয় জানেনÑ এই ধরনের ভাব আর আবেগপ্রবণ হওয়াটা আধুনিক, স্মার্ট হওয়ার লক্ষণ। ইদানীং এমনটি আমার প্রায়ই হচ্ছে। আর সে জন্যেই, মানে আমার ভেতরের স্মার্টনেস এতো দ্রুত বিকাশ লাভ করছে বলেই ও আমাকে ভালোবাসে; মানে আমাকে ওর ভালো লাগে। এই ভালো লাগালাগিটুকু আছে বলেই ও আমাকে বলে মেয়ে বন্ধু, আর আমি ওকে বলি ছেলে বন্ধু।
(মেয়ের সংলাপ চলাকালে ওয়েটার অন্য কোনো টেবিল থেকে অথবা অন্য কোনো কাজ করে ফিরে যাবার সময় কাঞ্চু তাকে ইশারা করে কাছে ডাকে এবং তার কানে কানে কিছু বলে। নির্দেশক লক্ষ্য করে ও বিরক্তি প্রকাশ করে।)
নির্দেশক : মেয়েটি আবারো বাইরের দিকে তাকায়। আবারো ঘড়ি দেখে।
মেয়ে : সেই কখন চারটা বেজে গেছে। ও এখনো আসছে না। কি করবো এখন?... তাহলে ততোক্ষণে নিজের কথা নিজের মনকেই শোনাতে থাকি।
মেয়ে এই সংলাপটি শুরু করতেই ওয়েটার প্ল্যাটফর্মের টেবিল থেকে মেনু তুলে নেয়। মেয়ে ‘ততোক্ষণে নিজের কথা নিজেকেই শোনাতে থাকি’ বলার সময় তার দু’হাত দু’দিকে শূন্যে অন্যমনস্কভাবে ছাড়িয়ে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়েটার মেয়েটির হাত গুঁজে দেয়। মেয়ে হকচকিয়ে যায়। সে সংলাপ থামিয়ে দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে নির্দেশকের দিকে তাকায়।
নির্দেশক : (রেগে) ওয়েটার।
ওয়েটার : (কাঞ্চুকে দেখিয়ে) উনিই তো স্যার...
কাঞ্চু : এই যে তুই বললি, ইমপো ভাই নাকি কি যেন ভাই, সেটাই একটু...
নির্দেশক : ইডিয়ট। (মেয়েকে) চালিয়ে যাও। (ওয়েটার চলে যায়।)
মেয়ে : (মেনু দেখিয়ে) এটা কি করবো।
নির্দেশক : তাই তো... ঠিক আছে হাতেই রাখো।
মেয়ে : ও আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। আমাদের ভাষায় ডেট-এ নিয়ে যাবে ওর গাড়িতে। ধরুন কোন লেকের ধারে। তারপর ফিরে এসে যাবো এক পার্টিতে। সেখানে গান হবে, নাচ হবে, হৈ হবে, চৈ হবে, তারপর উল্টোপাল্টা হুল্লোড় হবে, আমোদ হবে, ফুর্তি হবে। সবকিছু হবে আলো আঁধারে। সেই আমাদের গাঙ্গে স্নান করে, ফুর্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে রাত্রি যখন নিজেই বিভোর হয়ে যাবে, তখন এক মধুর ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবো। ফিরে যেতে ইচ্ছে না হলেও ফিরতে হবে। কারণ বাবা-মা বলে দিয়েছেন, ফিরতেই হবে। ওরা যে কী!... কিন্তু ফিরবো যে, যাওয়াই তো হলো না এখনো। ও না এলে তো...
নির্দেশক : মেয়েটি অস্থিরতা প্রকাশ করে। মেনুটাকে পাকা করে বাতাস খায়।... চমৎকার হচ্ছে কিন্তু, চমৎকার।
মেয়ে : (পাখা করা থামিয়ে) প্রতীক্ষা জিনিসটা সত্যি খুব খারাপ। আমার আরেকজন ছেলে বন্ধু টেলিফোন করেছিলো সকালে। সে বলেছিলো আমাকে নিয়ে একটা লংড্রাইভে যেতে চায়, আগেরবারের মতো। এবারে সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ, যেখানে ওই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে। কিন্তু আমি তাকে না করে দিয়েছি। আমার ডেট কার সঙ্গে, তা অবশ্য বলিনি। আমাকে ভজানোর জন্যে যা সুন্দর সুন্দর কথা বলছিলো। আমি নাকি ভেরি গুড ফান। ফান কথাটাই ফানি। মানুষ বুঝি তামাশা হতে পারে। তায় আবার মেয়েরা। আসলে কোনো মেয়েকে খোঁচা দিতে ইচ্ছে করলেই ছেলেরা তাকে বলে ফান। কথাটা কিন্তু আমার মনে হয় গালি। অথচ অনেক মেয়ে কথাটাকে খুব পছন্দ করে। কেউ কেউ ওটা হতে পারলে ভীষণ গর্ব অনুভব করে। কিন্তু...
নির্দেশক : সে কোমর থেকে ছোট্ট রুমাল টেনে নেয়। মুখটা মোছে।
মেয়ে : কিন্তু ওকেও এখন পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। ছেলেগুলো এমনই ফালতু, যেই একজন না বললো অমনি আরেকজনকে হ্যাঁ বলানোর জন্যে তার পিছে লেগে গেলো।
আচ্ছা, এমনো তো হতে পারে আমার ডেট অন্য কারো সাথে চলে গেছে। না না, তা হতে পারে না। ও এমনটি করতেই পারে না। আমি যে ওকে ভালোবাসি, মানে আমার ভালো লাগে। আমাকেও যে ওপর ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে।
(মেয়েটি কেঁদে ফেলে।)
নির্দেশক : মেয়েটি আবেগরুদ্ধ বলে কিঞ্চিৎ... কিঞ্চিৎ... (উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পায় না, হঠাৎ করে পেয়ে গেছে) ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে উঠে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে।
মেয়ে : তাহলে, তাহলে... এখন আমি কি করবো।
নির্দেশক : মেয়েটি বিমূঢ় হয়ে যায়। পরক্ষণই ছুটে যায় দরজার দিকে। থমকে দাঁড়ায়। ফিরে আসে টেবিলে। রুমালটা কোমরে গুঁজে রাখে। হাতের মেনুসহ বইটা ব্যাগের ভেতর ভরে ফেলে। কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পাঁচ পা... (নির্দেশক হাত নেড়ে গুনতে থাকে; কিন্তু মেয়েটি তিন পা যেয়েই থেমে যায়।)... তিন পা যেয়েই থেমে যায়।
মেয়ে : কয় পা যেন বললেন।
নির্দেশক : (অসন্তুষ্ট কণ্ঠে) পাঁচ। (মেয়েটি এগিয়ে যেতেই) সে আরো দু’পা যেয়েই থেমে যায়। ঘুরে দাঁড়ায়।
মেয়ে : ওয়েটার।
নির্দেশক : ওয়েটার দ্রুত প্রবেশ করে মেয়েটির কাছে চলে আসে।
ওয়েটার : জী।
মেয়ে : এখানে একটি ছেলে আসার কথা আছে। সে এলে তাকে বলবে...
ওয়েটার : আমি কি তাকে চিনি?
মেয়ে : ও, তাইতো। সে দেখতে ফর্সাও নয়, কালোও নয়, মুখটা গোলও নয়, লম্বাটেও নয়, খুব বেটেও না, ঢ্যাঙাও না, ঝাঁকড়া চুল, ঝুলে পড়া গোঁফ (চিবুক পর্যন্ত দেখিয়ে) এই পর্যন্ত জুলফি, পরনে একবারে হাল ফ্যাশনের পোশাক... চিনতে পারবে তো।
ওয়েটার : যেমন যেমন বললেন, তেমন তেমন হলে ঠিক চিনতে পারবো।
মেয়ে : তাকে বলবে যে আমি এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। সেও যেন অপেক্ষা করে। আমির আবার আসবো। বলতে পারবে?
ওয়েটার : হ্যাঁÑ আপনার নাম বলতে হবে না।
মেয়ে : নাম?... নাহ্, একটি মেয়ে বললেই চলবে। আর বলো যে, মেয়েটি ভীষণ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে চলে গেছে। বলতে পারবে তো।
ওয়েটার : দুখু-দুখু ভাব নিয়ে তোÑ ঠিক বলে দেবো।
নির্দেশক : মেয়েটি চলে যায়।... মিউজিক, প্যালেস। (মিউজিশিয়ান করুণ সুর বাজাতে থাকে। ওয়েটার হঠাৎ টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে মেনুটি নেই।)
ওয়েটার : এই যে শুনুন। (মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়। মিউজিক থেমে যায়।) আমাদের মেনুটা...
মেয়ে : ও, ভুলেই গিয়েছিলাম। এটার কথা আগে বলা হয়নি তো।
নির্দেশক : (মেয়ে ও ওয়েটারের এ্যাকশন দেখে দেখে) মেয়েটি এগিয়ে আসে। ওয়েটারও এগিয়ে যায়। মেয়েটি ব্যাগ থেকে মেনু বের করে ওয়েটারকে দেয়। মেয়েটি বেরিয়ে যায়। ওয়েটারও ফিরে যায়। (মিউজিশিয়ান সাসপেন্স মিউজিক বাজাতে থাকে।) সাসপেন্স মিউজিক।
তোমাকে ওটা বাজাতে বললো কে?
মিউজিশিয়ান : (থামিয়ে) আপনার নির্দেশের বাইরে তো স্যার এটা ওটা হয়ে যাচ্ছে তাই...
নির্দেশক : থামো প্যালেস। (মিউজিশিয়ান করুণ সুর বাজাতে শুরু করে।)
সামান্য নীরবতা। মিউজিক চলতেই থাকে।
কাঞ্চু : (কান চুলকাতে চুলকাতে) আবু, তোকে কিচ্ছু হবে না।
নির্দেশক : তুই বললেই হবে?
কাঞ্চু : হ্যাঁ, কোনো প্ল্যান নেই, কোনো রিহার্সাল ট্রেনিং কিছু নেই...
নির্দেশক : তবু হবে। আমি যাতে হাত দিয়েছি সেটা হতেই হবে।
কাঞ্চু : কচু হবে। সব ভ-ুল হবে। ওই ইমপো দিয়ে দিয়ে দিয়ে ঠেকাবি? তার চেয়ে ক্ষ্যামা দিয়ে...
নির্দেশক : (নিজের আসন থেকে উঠে কাঞ্চুর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে) তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না। তোর কাজ তুই কর। বিরক্ত করিসনে। এক্ষুণি ছেলে এসে পড়বে। (ফিরে এসে জাঁকিয়ে বসে। অতপর দর্শকদের দিকে মুখ রেখে) মিউজিক ডিরেক্টর ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে। (মিউজিশিয়ান আদৌ ঘাড় দোলাচ্ছে না। একটু পর নির্দেশক তার দিকে তাকায়।) তুমি তন্ময় ভাবের এক্সপ্রেশন দিচ্ছো না কেন? (মিউজিশিয়ান ঘাড় দোলাতে শুরু করে) হ্যাঁ, এইতো। (সামান্য পরে) ছেলেটি প্রবেশ করে। (এবারে ছেলেটির পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে স্যান্ডেল-সু, মাথায় ক্যাপ নেই। চুল বেশ ছোট করে ছাঁটা। গোফও নেই।) দাঁড়ায়। দেখে কেউ আছে কিনা। ঘড়ি দেখে। যেয়ে বসে একটি চেয়ারে। বাইরের দিকে তাকায়। ওয়েটার ছেলেটির কাছে আসে। ঘুরে ঘুরে তাকে ভালো করে দেখে। নেতিবাচকভাবে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ফিরে যায়। ছেলেটি ওয়েটারের আচরণ দেখে অবাক হয়ে যায়। আবারো ঘড়ি দেখে; মিউজিক স্টপ।
ছেলে : মেয়েরা কোনদিনই পাংকচ্যুয়াল হতে পারে না। নিশ্চয়ই এখনো ওর সাজগোজ শেষ হয়নি।
নির্দেশক : সে উঠে আসে দর্শকদের সামনে।
ছেলে : ওকে আমার ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। ওরও নাকি আমাকে ভালো লাগে। এই যে ভালো লাগালাগি একে যদি ভালোবাসা বলা যায়, তাহলেই মুশকিল। ভালবাসা ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দ নয়। এর চেয়ে প্রেম করা কথাটা শুনতেও ভালো, করাটাও বেশ আনন্দের। সে জন্যেই ভালোবাসতে ভালোবাসিনা, প্রেম করতে ভালোবাসি। প্রেম জিনিসটা একনাগাড়ে অনেকের সঙ্গে করা যায়। কিন্তু ভালোবাসাটা একজন ছাড়া হয় না। (ইতোমধ্যে ওয়েটার কাঞ্চুর ইঙ্গিতে ছেলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে।) আলী সাহেব একটা প্রবলেম।
নির্দেশক : কিসের প্রবলেম।
ছেলে : এই হাত দুটো দিয়ে কি করবো।
নির্দেশক : ও। তা... কখনো পকেটে রাখবে, কখনো বাইরে রাখবে। (ছেলে পকেটে হাত ঢোকায় ও দেশলাই বের করে। নির্দেশক ছেলেকেই অনুসরণ করে। সে সিগ্রেট বের করে। প্যাকেটে ঠুকে ঠুকে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরায়।)
ওয়েটার : (কাঞ্চুকে ফিসফিস করে) মেনুটা কি হাতে দেব?
কাঞ্চু : না থাক।
নির্দেশক : (কাঞ্চুকে) কি হচ্ছে?
কাঞ্চু : বিজনেস প্রসপেক্ট চিন্তা করছি।
ছেলে : কি, ভুল হয়েছে।
নির্দেশক : না, চালিয়ে যাও।
ছেলে : প্রেম কথাটা নিয়ে ইদানীং আমি বেশ ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছি। কারণ হচ্ছে গিয়েÑ কিছুদিন হলো আমার একটা গাড়ি হয়েছে। কেমন করে হয়েছে সে কথা আমার আত্মজীবনীতে লেখা থাকবে। আমার এক বন্ধু খুব ভালো খাতা লেখে। তাকেই বলেছি আমার আত্মজীবনী লিখে দিতে। শিগগিরই শুরু করবে সে। (সংলাপ ভুলে গেছে। মাথা চুলকাতে থাকে। সিগারেটে একটা-দুটো টান দেয়।) সেই গাড়িটা হওয়ার পর থেকেই আমার বেশকিছু শাসালো বন্ধু হয়েছে। আমোদ ফুর্তির আয়োজন হয়েছে। আরো কতো কি। এ সবের ফলেই প্রেম নামক জিনিসটা... এ সবের ফলেই... (আবারো ভুলে গেছে। সিগেরেট ফেলে দিয়ে নিভিয়ে দেয়। ঘড়ি দেখে। বাইরের দিকে তাকায়।)
নির্দেশক : (ফিসফিস করে) কি হলো থেকে আছো কেনো।
ছেলে : (ফিসফিস করে) লাইন ভুলে গেছি। কিউ ধরিয়ে দিন।
নির্দেশক : (ফিসফিস করে) এই রে সেরেছে।... (জোরে) সে পায়চারী করতে শুরু করে। (ছেলের পায়চারী করাকালে কাঞ্চু খিকখিক করে হাসতে থাকে। দর্শকদের ভেতর থেকেও দু’একজন হাসে। নির্দেশক বিরুক্ত হয়। ছেলেটিও অপ্রস্তুত বোধ করে।)
ছেলে : (পায়চারী করতে করতে একবার নির্দেশকের কাছে এসে ফিসফিস করে) আর কতো পায়চারী করবো।
নির্দেশক : (ফিসফিস করে) মনে করার চেষ্টা করো।
ছেলে : (ফিসফিস করে) পারছি না। আপনি ডায়ালগ বলে দিন।
নির্দেশক : (ফিসফিস করে) ওই যে ভালোবাসা ভালোলাগা এসব কথাই আবার শুরু করে দাও।
(ছেলে মধ্যমঞ্চে আসে। ভাবতে থাকে। কাঞ্চু কয়েকবার নকল কাশি দেয়।)
ছেলে : ওকে আমার ভালোলাগে। এতো ভালো আর কাউকে লাগেনি। সে আমার মনপ্রাণ সমস্ত অধিকার করে নিয়েছে। ওকে ছাড়া আমি আর কাউকেই ভাবতে পারি না। ওকে ছাড়া আমার জগৎ শূন্য মনে হয়। আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। মজনু যেমন লাইলির কুকুরকেও ভালোবেসেছিল, আমিও তেমনি ওর ছোঁচা বেড়ালটাকেও কোলে তুলে নিতে ঘেন্না করিনে।
নির্দেশক : তোমার ভয়েস-এ মডুলেশন নেই কেন; মডুলেশন আনো।
ছেলে : (জনান্তিকে) ওটাতো আপনারও নেই। (প্রকাশ্যে) আপনি একটু দেখিয়ে দিন।
নির্দেশক : (গম্ভীর গলায়) ছেলেটি অস্থির অস্থির ভাব করতে থাকে।
ছেলে : (নির্দেশককে অনুকরণ করে) কিন্তু সে আসছে না কেন? (কাঞ্চু খিক খিক করে হেসে উঠে। কয়েকজন দর্শকও জোরে হাসতে থাকে। ছেলে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে নিজেও মুচকি হাসে।)
নির্দেশক : (রেগে) কাঞ্চু।
কাঞ্চু : (হাসতে হাসতে) হাসি পেলে হাসবো না, নাকি এ্যাঁ।
নিদের্শক : (ছেলেকে) চালিয়ে যাও।
ছেলে : ছেলে ভাবতে ভাবতে গিয়ে বসে পুরুষ ও মহিলার জন্য সংরক্ষিত আসনে। ওই অংশে আবছা আলো জ্বলে উঠে। (স্বাভাবিক গলায়) কিন্তু সে আসছে না কেন? নাকি সে অন্য কারো সঙ্গে আজকের বিকেল কাটাতে গেছে।
আমি জানি ওকে অনেকেরই ভালো লাগে। না, না। সে অমন করবে না। সে আমায় কথা দিয়েছে। আজকের পার্টিতে সে আমার সঙ্গেই যাবে।... কি করবো আমি এখন?... একটা বিরহের গান গাইলে কেমন হয়।
নির্দেশক : মিউজিকÑ প্যালোস (মিউজিশিয়ান নির্দেশ পালন করে) ছেলেটি বিভ্রান্ত পায়ে ফিরে আসে টেবিলে। বসে। গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে।... হঠাৎ সোজা হয়ে বসে।
ছেলে : না, গান নয়।
নির্দেশক : মিউজিক স্টপ।
ছেলে : (একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে) তার চেয়ে ওর জন্যে একটা চিঠি রেখে যাই। এই হবে আমার শেষ সচিত্র প্রেমপত্র। উত্তেজিতভাবে যেয়ে বসে প্ল্যাটফর্মে। ওয়েটার...
নির্দেশক : চিঠি? চিঠির কথা তো বলা হয়নি। (ততোক্ষণে ওয়েটার এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।)
ছেলে : ইমপ্রোভাইজেশন। (ওয়েটারকে) এদিকে এসো। (ওয়েটার তার কাছে এগিয়ে আসে।)
নির্দেশক : বেশ তবে আর করবে না কিন্তু। মাফ করে দিলাম। দরকার হলে আমিই ইমপ্রোভাইজ করে দেবো।
ছেলে : (ওয়েটারকে) এক টুকরো কাগজ আর কলম-টলম দাও তো।
কাঞ্চু : এই যে নায়ক সাহেবÑ
ছেলে : বলুন।
কাঞ্চু : মেনুতে কাগজ কলমের কথা নেই।
নির্দেশক : কাঞ্চু!
কাঞ্চু : ইমপোভাই।
ছেলে : (ওয়েটারকে) যাও, নিয়ে এসো।
নির্দেশক : (হঠাৎ তার নিজের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়, দাঁড়িয়ে যায়) না, না। (ওয়েটার যেতে যেতে থেমে যায়) ঠিক মতো সিকোয়েন্স অনুযায়ী করে যাও।
ছেলে : সিকোয়েন্স!
নির্দেশক : হ্যাঁ। আমি নির্দেশ দিচ্ছি। কেন তোমার জানা নেই, আমার নির্দেশ তোমাকে বিনাদ্বিধায়, বিনাপ্রশ্নে পালন করতে হবে?
ছেলে : হ্যাঁ, তাই।... কিন্তু...
নির্দেশক : কিন্তু কি?
ছেলে : উল্টোপাল্টা করে ফেললে?
নির্দেশক : উল্টোপাল্টা করলে! জানো, সোজা জিনিসকে উল্টোপাল্টা করলে কি হয়?
ছেলে : (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) একটু অন্যরকম দেখায়, এই আর কি।
নির্দেশক : তোমাকে যদি পা দুটো উপরে তুলে হাঁটতে বলি সেটা কি রকম দেখাবে?
ছেলে : হ্যাঁ, এরকম একটা যোগ ব্যায়াম আছে, শুনেছি।
নির্দেশক : কি রকম দেখাবে, সেইটে বলো।
ছেলে : লোকে দেখবে নির্দেশক সাহেব অমনটিই চান। কারণ...
নির্দেশক : কারণ?
ছেলে : নির্দেশক সাহেবের নিজের ওই যোগ ব্যায়ামটি খুব পছন্দের।
(কাঞ্চু, ওয়েটার ও দর্শকরা হেসে উঠে।)
নির্দেশক : (ছেলের দিকে কিছুক্ষণ ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে) বেশ। (একটু থেমে) দরকার হলে তোমাকে মাফ করে দেবো। অবশ্য দরকারটা যদি হয় আমার। বলতে বলতে বসে পড়ে। নইলে নাটক বন্ধ করে দেবো।
ছেলে : ওয়ান্ডার ফুল। তাহলে তাই দিন। (উঠে দাঁড়ায়)
নির্দেশক : হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে তাই দেবো।
ছেলে : আপনার পাঁঠা- ল্যাজে কাটেন আর মাথায় কাটেন আমার কি।
নির্দেশক : আমার নাটকের জন্যে তোমার একটু দরদও নেই?
ছেলে : থাকতো, যদি বেদরদের মতো কথা না বলতেন।
কাঞ্চু : এ রকম বেনজির ব্যাপার-স্যাপার চলতে থাকলে...
নির্দেশক : তুই এর মধ্যে বেমক্কা কথা বলিস নে।
কাঞ্চু : আ—চ্ছা।
ছেলে : এ সব বেতালা কথাটথা বাদ দিয়ে নাটক বন্ধ করে দেবার প্রস্তাবটাই গ্রহণ করলাম। (‘করলাম’ কথাটার সঙ্গে সে টেবিলে একটা ঘুষি মেরে চলে যেতে উদ্যত হয়।)
নির্দেশক : না, এখনই বন্ধ করতে চাই না।
ছেলে : তাহলে ডায়ালগ ধরিয়ে দিন।
নির্দেশক : সে তোমারই মুখস্ত রাখার কথা।
ছেলে : তবু প্রম্পটার রাখতে হয়।
নির্দেশক : সে আমলের কথা ভুলে যাও। সে সিস্টেম এখন আর নেই।
ছেলে : তাহলে... ইমপো?
নির্দেশক : আপাতত। সেটাও আমার নির্দেশ মতো।
ছেলে : বেশ। কিন্তু এখন?
নির্দেশক : (যেন হঠাৎ ওয়েটারকে দেখে) ওয়েটার ভেতরে চলে যায়। ছেলেটি বিষণœ মনে বসে পড়ে। (ছেলে সিগারেট ধরায়) ছেলেটি সিগারেট ধরায়।... ডায়ালগ।
(ছেলেটি নিশ্চুপ। উদাস মনে সিগারেট টানতে থাকে।) নীরব কেন? শুরু করো।
ছেলে : ভাবÑ ভাবের জন্যে। ভাবতে হবে। (সিগারেট টানে)
নির্দেশক : ছেলেটি ভাবের ঘোরে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়ে।
ছেলে : না, না, গান নয়। গান কেন? কেন বিরহের গান গাইবো! সেটা হবে আমার পরাজয়। তার চেয়ে আমি চলে যাবো। সেই হবে তার চরম শাস্তি। এসে যখন দেখবে আমি নেই। নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলবে। বিরহের গান তখন সেই গাইবে। আমি কেন? তারপর হয়তো আমাকে টেলিফোন করবে। আমাকে পাবে না। আমি তো বাড়িতে নেই তখনÑ পার্টিতে। কিন্তু যদি পার্টিতে যেয়েই হাজির হয়। এমনো তো হতে পারে, অন্য পার্টিতে চলে গেলো। মরুক গে, আমি চললাম।
নির্দেশক : প্রচ- বিক্ষোভে সে সিগ্রেটটা এ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে দাঁড়ায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে। মুখ মুছে। রুমালটা পকেটে রাখে। দরজার দিকে এগোতে থাকে। ঠিক তখনি প্রবেশ করে মেয়েটি। ছেলেটি থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটিও থমকে দাঁড়ায়।
ছেলে : এতোক্ষণে সময় হলো!
মেয়ে : আমি তো অনেকক্ষণ আগেই এসেছিলাম।
ছেলে : আমিও অনেকক্ষণ আগে এসেছি।
মেয়ে : আমি এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম। কেন, ওয়েটার তোমাকে বলেনি।
ছেলে : কই, না তো।... ওয়েটার
নির্দেশক : ওয়েটার দ্রুত পায়ে ছুটে আসে।
ছেলে : এর আসার কথা আমাকে তুমি আগে বলোনি কেন?
ওয়েটার : ও, আপনিই সেই লোক!
ছেলে : মানে!
ওয়েটার : মেয়েকে দেখিয়ে উনি বললেন, লম্বা চুল, ইয়া জুলফি, বর্ষার ঘাসের মতো গোঁফ, বাহারি পোশ??