
ছবি: সংগৃহীত
সৌরজগতের অষ্টম ও সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুনকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে রহস্যের জাল। এ গ্রহ এতটাই দূরে যে সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা, যেখানে পৃথিবীতে লাগে মাত্র ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। এতটা দূরত্বের কারণে এ গ্রহে মানুষের পদচারণা হয়নি, তবে ১৯৮৯ সালে নাসার ভয়েজার ২ নভোযান এর খুব কাছ দিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় পাঠানো ছবিতে দেখা যায় এক অদ্ভুত নীল গ্রহ, আর শুরু হয় নতুন জল্পনা—গ্রহটিতে কী এমন আছে যা একে এত আলাদা করে তুলেছে?
ভয়াবহ ঝড় আর তাপের উৎস: রহস্যের শুরু
নেপচুনে পাওয়া গেছে সৌরজগতের সবচেয়ে দ্রুতগতির ঝড়। সেখানে বাতাসের গতি ঘণ্টায় প্রায় ২১০০ কিলোমিটার, যা শব্দের গতিকেও হার মানায়। এমন তীব্র বাতাস আর উত্তপ্ত গ্রহকে ঘিরে বিজ্ঞানীরা প্রথমে ধারণা করেন, হয়তো কোনো পরিমাপে ভুল হচ্ছে। তবে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন—না, ভুল নয়। সূর্য থেকে এত দূরে থাকা সত্ত্বেও গ্রহটি অপ্রত্যাশিতভাবে গরম। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, নেপচুন সূর্যের যে পরিমাণ আলো গ্রহণ করে, তার প্রায় ২৯ শতাংশ প্রতিফলিত করে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ, গ্রহটি যে তাপ গ্রহণ করছে, তার চেয়ে বেশি তাপ দিচ্ছে—এটা কীভাবে সম্ভব?
হিরার বৃষ্টি: এক বৈজ্ঞানিক কল্পনা নয়, বাস্তব সম্ভাবনা
এখানেই সামনে আসে একটি চমকপ্রদ তত্ত্ব—নেপচুনে হিরার বৃষ্টি হয়। এবং এই হিরা কিন্তু আমাদের গহনার হিরের মতো নয়, বরং ন্যানো হিরা—অতিক্ষুদ্র স্ফটিক। বিজ্ঞানীদের মতে, নেপচুনের বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ চাপ ও তাপ রয়েছে, তা মিথেন গ্যাসের ভেতরের হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু আলাদা করতে পারে। সেই আলাদা হওয়া কার্বন একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে হিরার মতো কঠিন কণা। এই হিরার কণা ভারী হয়ে পড়ে যেতে থাকে গ্রহের গভীরের দিকে। অনেকটা আকাশ থেকে বৃষ্টির মতোই। এই পতনের সময় ঘর্ষণের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়, এবং সেখান থেকেই আসছে নেপচুনের অতিরিক্ত তাপ।
পলিথিনের পরীক্ষা: যেভাবে এক প্লাস্টিক কাপ দেখাল নেপচুনের গোপন প্রক্রিয়া
এই তত্ত্ব কি কেবল কল্পনা? না, বিজ্ঞানীরা বাস্তবে তা প্রমাণও করেছেন। নেপচুনে যাওয়ার মতো প্রযুক্তি এখনো হাতে না থাকলেও বিজ্ঞানীরা মিথেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেছেন সস্তা ও সহজলভ্য একটি বস্তু—পলিথিন। পলিথিনের গঠন মিথেনের মতোই হাইড্রোকার্বন ভিত্তিক। গবেষকরা পলিথিনের ওপর শক্তিশালী লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে দেখেছেন, প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে পলিথিনের হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু আলাদা হয়ে গিয়ে কার্বন স্ফটিক—অর্থাৎ হিরা গঠিত হয়।
এই পরীক্ষায় উঠে এসেছে—পলিথিনের উপর লেজারের ধাক্কা হুবহু নেপচুনের গভীরের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে এই ছোট ছোট হিরার কণাগুলো তৈরি হয়, যা বিজ্ঞানীদের মতে, নেপচুনেও তৈরি হচ্ছে, তবে অনেক বড় পরিসরে এবং অনেক বেশি ঘনত্বে।
হিরাগুলো কোথায় পড়ে? আর কী আছে নেপচুনের গভীরে?
যদিও এখনো পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না, এই হিরার বৃষ্টি কোথায় গিয়ে পড়ে। কেউ বলেন, গ্রহটির কেন্দ্রে হয়তো জমে উঠছে হিরের আস্ত স্তর। আবার কেউ মনে করেন, সেখানে হয়তো রয়েছে হিরার বরফখণ্ড, যেগুলো তরল স্তরের মধ্যে ভাসছে। এসবই এখনো জল্পনা, তবে যুক্তিযুক্ত জল্পনা। বাস্তবতা জানতে হলে হয়তো ভবিষ্যতে রোবটবাহী কোনো নভোযান পাঠাতে হবে নেপচুনে।
শুধু বিজ্ঞান নয়, কল্পনাও শক্তি দেয়
এই গবেষণা প্রমাণ করে, এমনকি ফেলে দেওয়া একটি কফি কাপের প্লাস্টিকও হতে পারে সৌরজগতের গভীর রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি। বিজ্ঞান ও কল্পনার মিশেলে আমরা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছি নতুন নতুন তথ্য, যা পৃথিবী ছাড়িয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বের অজানা কোনায়। আর সেখানে হয়তো সত্যিই ঝরে পড়ে হিরার বৃষ্টি—শুধু আমাদের চোখে দেখা হয়নি এখনো।
রাকিব