ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফ্যাসিবাদের উত্থান ও সংবিধান পরিবর্তন

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১৯ মে ২০২৫

ফ্যাসিবাদের উত্থান ও সংবিধান পরিবর্তন

.

স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের গণপরিষদে এই সংবিধান গৃহীত হয়, ঐ বছর ১৬ ডিসেম্বর হতে সংবিধান কার্যকর হয়। একাত্তরে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে স্বাধীনতা লাভ করেছি আমরা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হবে, তার জন্য সংবিধান রচিত হয়েছিল প্রায় আট মাসে। এ সংবিধান প্রণীত হয়েছিল শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ  দিকনির্দেশনায়।
তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত হয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। এই কমিটির সদস্য ছিলেন ৩৪ জন। কমিটি ভারত ও যুক্তরাজ্যের সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেছিল। সংবিধানের খসড়া সর্বপ্রথম গণপরিষদে উত্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর। এরপর ৪ নভেম্বর তা গণপরিষদে গৃহীত হয়। ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সংবিধানটি রচিত হয়েছিল সেই সংবিধানটি এই দেশের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের জন্য কতটা যুক্তিযুক্ত অধিকার রাখা হয়েছে- এমন গুরুতর ও সংবেদনশীল প্রশ্ন উঠেছে বারবার। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের জন্ম, সেই সময়ে কেমন বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম এসবের প্রতিফলন রয়েছে আমাদের সংবিধানে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের ৫৪ বছরে  সংবিধানে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। এতবার সার্জারি করার পরও ছোট এই দেশটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি।  যদিও বারবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়েছে, পার্লামেন্টারি কার্যক্রম চলেছে,  মন্ত্রিপরিষদ গঠন হয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে।  অসংখ্য রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ ও খুনাখুনির মধ্য দিয়ে।
এরপরও লাখো মানুষের খুনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কি কাক্সিক্ষত মানের, বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পেরেছে? মুক্তিযুদ্ধের পর দেশটির রাষ্ট্র কাঠামো  ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত হয়েছে। স্বাধীন দেশের নতুন সংবিধানে ভারতীয় মদতপুষ্ট আওয়ামী সরকার বিভাজিত রাজনৈতিক দর্শন প্রয়োগে ভিন্নমত ও পথ দলনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায় একক ও একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে শেখ মুজিব সরকার। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ১৯৭২ সালে রচিত দেশের প্রথম সংবিধানের ‘দুর্বলতাকে’ দায়ী করেছে কমিশন। তারা বলছে, ‘ফ্যাসিবাদের বীজ ’৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই নিহিত ছিল। ‘ড. আলী রীয়াজের মতে, এই যে রাজনৈতিক দল তার যে আদর্শ, সেটা জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বিবেচনা থেকে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই কাজটি রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে এখন আর গ্রহণযোগ্য নেই।’
সংবিধান কাটাছেঁড়া করে  সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন শেখ মুজিব। নিজ দল আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে  দু’বার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। বোধ-বুদ্ধি নিগূঢ় জ্ঞান দিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই, শুধু সাধারণ জ্ঞান দিয়েই যদি কেউ অনুসন্ধান করে, তবে সে দেখতে পাবে বিগত শাসকগোষ্ঠী সংবিধানে যে সংশোধনীগুলো এনেছে, তার বড় অংশই হয়েছে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোকে আরও এককেন্দ্রিক করার লক্ষ্যে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে।  কতক সংশোধনীতে আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মূল সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করা হয়েছে। দুইবার ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্র, সেনাশাসন, একদলীয় ব্যবস্থা এবং ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করার বিষয়টি সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই ছিল। প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী বাহাত্তরের   সংবিধানে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা  যথাযথ হয়নি। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের কোনো পথ রাখা হয়নি, যা এখনো নেই।
১৯৭১ সালের মূলনীতির আলোকে  সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার বাহাত্তর সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সংবিধানে চারটি মূলনীতির কথা যুক্ত হয়েছিল। যেখানে এটিই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতি। এ কাঠামোই ক্ষমতার এককেন্দ্রীয়করণ করেছে, যার জন্য সময়ের কাঠগড়ায় আমরা দাঁড়িয়েছি। সংবিধানে চারটি মূলনীতির কথা যুক্ত হয়েছিল, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো দলের মূলনীতি যখন রাষ্ট্রের মূলনীতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নির্ধারণ করেছে  বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ কী হবে। যে আদর্শকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তা রাখা হয়নি, জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো হয়নি। ’৭২-এর সংবিধানে  বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীকে প্রতীকী অর্থে নিশ্চিহ্ন বা অস্বীকার করা হয়েছে। এ সংবিধানের বড় দুর্বলতা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে সংবিধান তখনো প্রণয়ন হয়নি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন বলেছে, এগুলো বাংলাদেশ রাষ্টের  আদর্শ হবে। স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক কোনো ম্যান্ডেট ছিল না।
ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত করতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে  একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করা হলো। এভাবে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করেন এবং আদর্শের দিক দিয়ে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন। পরবর্তীতে যেটি মুজিববাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই মুজিববাদই তৈরি করেছে এক দেশ, এক নেতা। এভাবেই ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে বাহাত্তরের সংবিধান।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। এ দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত হয়েছে ১৯৮৮ সালে, যা এখনো বিদ্যমান। তারপর থেকে অনেক সরকার এলো। কিন্তু কেউই তা বদল করেননি। কোনো সরকারই জনগণের সেন্টিমেন্টে আঘাত করার সাহস দেখায়নি। আরেকটি কারণ রাজনৈতিক বাস্তবতা। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন অনলাইনে সংবিধান নিয়ে মতামত জানতে চেয়েছে, তখন বিশালসংখ্যক সাধারণ নাগরিক  এটা রাখার পক্ষে জোড় মত দিয়েছেন।  প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষ চাইলেই কী তা রাখতে হবে? হ্যাঁ অবশ্যই।  দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে কোনো সংবিধান প্রণয়ন করা যায় না। আমাদের মনে এ ভাবনাই ছিল। রাষ্ট্রধর্ম রাখা না রাখা নিয়ে কমিশনের সদস্যদের মাঝেও ভিন্নমত ছিল, বিতর্ক ছিল, তবে বড় একটা অংশই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামের পক্ষে ছিলেন।  এটা যতটা না ধর্ম হিসেবে ইসলামের পক্ষে, তারচেয়ে বেশি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো।
বাংলাদেশের সংবিধানে আমাদের জাতি হিসেবে বাঙালি বলে পরিগণিত করা হয়। এটি তুলে দিতে বলেছি। নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি পরিচয় এখনো আছে।  জুলাই-আগস্ট বিপ্লবোত্তর নতুন বাংলাদেশে প্রফেসর ড.আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন বহুত্ববাদের কথা বলেছে। বাংলাদেশের ছোট্ট ভৌগোলিক সীমানায় অসংখ্য জাতি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে।  চাকমা, মারমা, গারো, রাখাইন ও অবাঙালিদের বহুত্ববাদও অন্তর্ভুক্ত।  বহুত্ববাদ যে কেবল ধর্মীয়ভাবে মতপার্থক্য, ভিন্নমত বা ভিন্ন অবস্থার সহনশীলতা তৈরি করবে, তা নয়। অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষদেরও কাছে টানবে।
অন্যভাবে বিবেচনা করলে; যিনি দলিত সম্প্রদায় তাকেও সমতার মর্যাদা দেবে। কিন্তু এতদিন তাকে সমতার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। সমতার ধারণাকে বড় করতে হবে এবং সকল জাতি গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এমন কী তৃতীয় লিঙ্গকেও রাষ্ট্র সমান মর্যাদা দেবে। যারা অর্থপাচার ও  লুটপাটের সঙ্গে জড়িত,  তাদের অনেকেরই একাধিক দেশে নাগরিকত্ব রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের মোকাবিলা করতে সংবিধানে নতুন বিধান যুক্ত করা যেতে পারে।
গত ৫৪ বছরে অর্থপাচার ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে দেশে আইনের শাসন না থাকায়। আমাদের সংবিধানকে সব সময়ই সংসদ সদস্য, আইনজীবী ও আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। সংবিধান পাঠ কষ্টসাধ্য ও কিছুটা দুর্বোধ্য- এমন কথা প্রচলিত আছে। সংবিধান বিষয়ে এমন ধারণা অনেকের মাথায় রয়েছে।
১২-১৪ মিলিয়ন বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছেন। তাদের  একটি অংশ সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। দেশের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখছেন। অর্থপাচারকারিদের  দ্বৈত নাগরিকত্বের কথা যখন ভাবব, তখন প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের কথাও সম্মানের সঙ্গে মনে রাখতে হবে।   স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়, তখন প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামল। তারা ভোট দিতে পারেন না এবং রাজনৈতিকভাবেও তেমন উচ্চকণ্ঠ নন।
প্রবাসীদের জন্য ভোটদানের ব্যবস্থা করা একেবারেই অসম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই  থাকেন না কেন, তাদের দূতাবাসে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা যেখানেই বাস করুক না কেন, তাদের ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক সে দেশের সংবিধানে। বাংলাদেশের অসংখ্য রেমিটেন্স যোদ্ধা দেশের বাইরে থেকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। তাদের ভোটাধিকার  থাকবে না, এমনটি হতে পাওে না।
নব্বইয়ের শ্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল। পরবর্তীতে তার  প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান লক্ষ্য হলো, ক্ষমতার এককেন্দ্রিকীকরণ রুখে দিয়ে  ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করা। ব্যক্তির শ্বৈরাচার হয়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করা। ক্ষমতা যখন একক ব্যক্তির হাতে থাকে, তখন স্বৈরতন্ত্র ডালপালা মেলে ধরে। বিগত সময়ে তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। রাষ্টের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফ্যাসিবাদ রুখতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং ক্ষমতা এমনভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে,  যাতে কোনো একক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা না থাকে। আগামীর বাংলাদেশে আর কেউই যেন ফ্যাসিবাদের লালন-পালনকারী না হয়, নতুন সাংবিধানিক বন্দোবস্তে জনগণের সুরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করবে, এমনটিই আশা করছেন দেশের নাগরিকগণ।
লেখক : সাংবাদিক

 

×