
নিষিদ্ধ ঝুঁকিতে আ’লীগ শরিকরা
আওয়ামী লীগের পর এবার নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে দলটির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিসহ (এরশাদ) ১৪ দলীয় জোটের বাকি শরিকরা। পতিত আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে এই দলগুলোর কয়েকটি সরকারের মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছে। জোটের রাজনীতিতেও ছিল সক্রিয়।
অভিযোগ রয়েছে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় এরা সরাসরি সরকারকে মদত দিয়েছে। এসব কারণে আওয়ামী লীগের পর জোটের অন্য দলগুলোকে নিষিদ্ধের দাবি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের নিষিদ্ধের দাবিতে নির্বাচন কমিশনসহ সরকারকে আইনি নোটিসও পাঠানো হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই কাগজ-কলমে না হলেও কার্যত নিষিদ্ধ ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম। জন আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার নির্বাহী আদেশে গত ১০ মে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যা বহাল থাকবে ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগের কর্মকা- নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সহযোগী দল হিসেবে ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়েও আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। আওয়ামী লীগের শরিক বাকি ১৩ দলকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জুলাই ঐক্য। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত।
আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা হলো- জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, গণ আজাদী লীগ, বাসদ (রেজাউর), সাম্যবাদী দল (দিলীপ বড়ুয়া), ন্যাপ (মোজাফফর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাসদ (ইনু), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, তরিকত ফেডারেশন ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র।
২০১৪, ১৮ ও ২৪ এর নির্বাচনের জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বাকি শরিক ১৩টি দলই ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট হওয়ার পেছনে প্রধান শক্তি। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলশূন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় পার্টি। সর্বশেষ, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে ১৪ দলের বৈঠক থেকে। এসব কারণেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তাদের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলকেও নিষিদ্ধের দাবি ক্রমশ প্রবল হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। ৫ আগস্টের পর জোটের শরিক একটি দলও প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক তৎপরতায় দেখা যায়নি। বরং আতঙ্কে শরিক দলের প্রধান প্রধান নেতাদের কেউ চলাচল করছেন গোপনে, অধিকাংশ রয়েছে আত্মগোপনে। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুসহ ১৪ দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন কারাগারে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে ১৪ দলীয় জোটের অধিকাংশ রাজনৈতিক কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের পদচারণা নেই বললেই চলে।
৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অভ্যুত্থানে হত্যাকা-ের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হয়, সেখানে শেখ হাসিনাসহ তার সরকার, দল ও জোটের অনেক সহযোগীর বিরুদ্ধ জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া দেশের অন্যান্য প্রান্তেও শেখ হাসিনার নামে হত্যা মামলা হয়েছে, সেখানে আসামি হয়েছেন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ১৪ দলের অনেক নেতাকর্মীও।
ইতোমধ্যে গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসাবে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বরাবর অভিযোগ দাখিল করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। এরই মধ্যে দল-সংগঠন নিষিদ্ধের ক্ষমতা পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৪ দলও কী নিষিদ্ধ হচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন অঙ্গনে।
১৪ দল নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ, পতিত শেখ হাসিনার সরকার যখন অভ্যুত্থান দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছিল, তখন সরকারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে নানা বক্তব্য দিয়েছে ১৪ দলের নেতারা। এমনকি আগস্টের প্রথম থেকে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামারও পরিকল্পনা ছিল তাদের।
যদিও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট সরকারের পতন হয়। মূলত হাসিনা সরকারের দমননীতির পক্ষে এমনভাবে অবস্থান নেওয়ার ফলেই তাদের ওপর ক্ষুব্ধ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনগুলো। এসব কারণেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনও আমরা ভাবিনি। দলীয়ভাবে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিলে গণমাধ্যমে জানানো হবে।
বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এবার তাদের সহযোগী হিসেবে ১৪ দলের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ছাড়া যারা অবৈধ ও পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা জনকল্যাণে ব্যবহারের তাগিদ দেন দলটির নেতারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গত ১২ মে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগের সহযোগী ১৪ দলের ব্যাপারে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। দ্রুত তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি আমরা। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের দিকে লংমার্চ করবে ছাত্র-জনতা। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে দ্রুত বিচার কার্য বুঝিয়ে দিতে হবে, নয়তো জনগণের আদালতে আপনার বিচার হবে।
এ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলেও এখন পর্যন্ত তাদের সহযোগী দলগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমরা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে দাবি জানিয়ে আসছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের বাকি শরিকদের নিবন্ধন বাতিল করার জন্য। যদি সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয় প্রয়োজনে আমরা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করব।
জুলাই ঐক্যের অন্যতম সংগঠক এবি জুবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি পরিষ্কার করেছি। শুধু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আমরা কার্যক্রম নিষিদ্ধ চাইনি। ছাত্র জনতা চেয়েছে দল হিসেবে নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগের শরিকদের বিষয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। গেজেট অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন হিসেবে ১৪ দলের শরিকরাও নিষিদ্ধ। কিন্তু আমরা দেখেছি সরকার শুধু আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এর আগে ১৪ দলীয় জোটের বাকি দলগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনসহ সরকারকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মী পরিচয় দেওয়া হোসাইন মো. আনোয়ার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আইন সচিব ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব বরাবর এ নোটিস পাঠানো হয়।