
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক কোটা ও দলীয় আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত। মেধা, যোগ্যতা ও গবেষণা সক্ষমতা নয়—বরং রাজনৈতিক পরিচয়, দলীয় মতাদর্শে আনুগত্য এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে শিক্ষক নির্বাচন যেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেবল পাঠদানের দায়িত্ব পালন করেন না; বরং তারা জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান কারিগর, মূল্যবোধের ধারক এবং গবেষণায় পথপ্রদর্শক। কিন্তু যখন এই গুরুদায়িত্ব অযোগ্য ও দলনির্ভর ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই শুধু নয়—সমগ্র সমাজই নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
দলীয় কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের এই প্রবণতা শুধু একটি প্রজন্ম নয়, পরপর বহু প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। মুক্তবুদ্ধির চর্চা মুখ থুবড়ে পড়ে, প্রশ্নবিদ্ধ হয় শিক্ষকের মর্যাদা, আর ছাত্রদের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হারিয়ে গিয়ে তা একসময় রূপ নেয় দলীয় ক্ষমতা সংহত করার হাতিয়ারে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এইসব অনিয়মিত ও রাজনৈতিক প্রভাবিত নিয়োগের পেছনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বচ্ছতার ঘাটতি, উপাচার্য ও সিন্ডিকেটের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা এবং নিয়োগ বোর্ডের অনিয়মিত সিদ্ধান্ত। এতে করে বহু যোগ্য, মেধাবী প্রার্থী শুধু রাজনৈতিক পরিচয় না থাকার কারণে বঞ্চিত হন। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর বাস্তব উদাহরণ দৃশ্যমান, যা দেশের উচ্চশিক্ষাকে মেধাশূন্য করার পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ গঠনের স্বপ্ন সুদূরপরাহত হয়ে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রূপ নেবে কেবল সার্টিফিকেট বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানে, আর শিক্ষকতা হবে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত একটি প্রক্রিয়া—যেখানে গুণগত মানের কোনো স্থান থাকবে না।
এমন ভয়াবহ ভবিষ্যৎ থেকে উত্তরণের জন্য এখনই প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মেধা ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা নয় শুধু মেধা ও যোগ্যতা হবে চূড়ান্ত মানদণ্ড।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নির্বাচন করতে হবে জাতীয় স্বার্থের আলোকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে। অন্যথায় আমরা যে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবো, তার দায় বহন করতে হবে আগামী বহু প্রজন্মকে।
Mily