
মহারাজ হাভিকো কোরিনো (মার্ক স্ট্রং) কোনও বেনে জেসেরিটকে আর রাজপ্রাসাদে স্থান দিতে চান না। তাদের তথাকথিত পরামর্শের প্রয়োজন হাভিকোর নেই। ডেসমন্ড হার্ট (ট্র্যাভিস ফিমেল)-কে তিনি তাঁর নতুন ‘বাশার’ (সেনাপতি) বানিয়েছেন। ডেসমন্ড সেই চেষ্টাতেই ছিল। বেনে জেসেরিটরা তার চিরশত্রু। কিন্তু মাদার সুপিরিয়র ভালেয়া হার্কোনেন (এমিলি ওয়াটসন) এত সহজে সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। বেনে জেসেরিটদের শক্তি ইমপেরিয়াম (রাজত্ব)-এ খর্ব হয়ে থাকবে, তা তিনি কখনওই মেনে নেবেন না। ডাক পড়ে তাই সিস্টার ফ্রাঞ্চেস্কা-র (তব্বু)। কূটনৈতিক অভিজ্ঞতায়, ইমপ্রিন্টিং (বেনে জেসেরিটদের অন্যকে বশ করবার এক বিশেষ শৈলী)-এর পারদর্শিতায় এবং সর্বোপরি রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণের মারাত্মক ক্ষমতায় সিস্টার ফ্রাঞ্চেস্কার জুড়ি মেলা ভার। ভালেয়ার সিদ্ধান্ত জলে যায় না। বেনে জেসেরিটদের হাত থেকে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া ঘুঁটি হাভিকো সিস্টার ফ্রাঞ্চেস্কার প্রচেষ্টায় আবারও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বেনে জেসেরিটদের জয় হয়।
কিন্তু কারা এই বেনে জেসেরিট? ফ্রাঙ্ক হারবার্ট বিরচিত এবং অ্যালিসন শ্যাপকার পরিচালিত ‘ডিউন প্রফেসি’ সিরিজে এরা হল এক কাল্পনিক সিস্টারহুড। তাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শক্তি অকল্পনীয়। তারা একটি গোপন এবং স্বতন্ত্র দল, যাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হল ‘সিলেক্টিভ ব্রিডিং’ এবং রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে মানবতার ভবিষ্যৎকে সূক্ষ্মভাবে নির্দেশনা দেওয়া। গুপ্তচরবৃত্তি তাদের কর্মকাণ্ডের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। নারীশক্তি যে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে গুপ্তচরবৃত্তির মতো যে-কোনও সূক্ষ্ম স্তরে কী অভাবনীয়ভাবে সফল হতে পারে— ‘ডিউন প্রফেসি’ তা প্রমাণ করে।
কিন্তু বাস্তবের মাটিতে মানবতার ইতিহাস জুড়ে, বিশেষত গোয়েন্দা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে, নারীদের অবদান প্রায়শই উপেক্ষিত থেকেছে। তা সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা ইতিহাসে নারী গুপ্তচরদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নারী গুপ্তচররা পুরুষ-প্রধান গোয়েন্দা জগতের প্রচলিত ধারণা ভেঙে অনেক সময়ই মাইলফলক সৃষ্টি করেছেন।
আধুনিক ইউরোপে নারী গুপ্তচরদের ভূমিকা গবেষকরা যতটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। নারীদের রাষ্ট্রদূত বা সরকারি কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ করা হত না। তাঁরা সচিবালয় বা ডাক বিতরণ কেন্দ্রের মতো বিকল্প ও আধা-ব্যক্তিগত স্থানগুলিতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকতেন। ইংল্যান্ডে সেই যুগের কনভেন্টগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, সন্ন্যাসিনীরাও (নান) রাজনীতি ও গোয়েন্দাগিরিতে জড়িয়ে ছিলেন। স্টুয়ার্ট রাজবংশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করা কয়েকজন সন্ন্যাসিনী (নান)-দের কথা জানা যায়। তবে তাঁদের এবং অন্যান্য উদাহরণগুলো এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হয়। আধুনিক গোয়েন্দা বা গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে সাধারণত সপ্তদশ শতাব্দীর গুপ্তচর জগৎকে নারীশূন্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়। অথচ, নারীরা সবসময়ই ভাল গুপ্তচর হতে পারেন। তাঁরা বহু কাজ একসঙ্গে করতে এবং বিভিন্ন আবেগকে কাজে লাগাতে দক্ষ। গুপ্তচরবৃত্তিকে পুরুষের কাজ মনে করা হয় বলেই সম্ভবত নারীরা তা আরও ভাল করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ডাচ নর্তকী মাতা হারি নারী গুপ্তচরদের এক ঐতিহাসিক প্রতীক। কিন্তু ১৯৪৫ সালেই ম্যাক্সওয়েল নাইট নামের যুদ্ধকালীন একজন গোয়েন্দা ছিলেন, যাঁকে ফ্লেমিং-এর স্পাই থ্রিলারে ‘এম’ চরিত্রের আদর্শ মনে করা হয়। তিনি নারী-নিয়োগের ক্ষেত্রটিকে অমূলক কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাখার বিরোধী ছিলেন। তিনি যৌনতাকে নারী এজেন্টদের কাজে অস্থির ও বিপজ্জনক ভাবার ধারণাগুলিকে খারিজ করতেন। তিনি ‘মাতা হারি পদ্ধতি’-র ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং সহকর্মীদের কাছে একটি মেমোতে লিখেছিলেন: ‘আমি নিশ্চিত, পুরুষের বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার বদলে দূরে থাকার মাধ্যমেই নারী এজেন্টরা বেশি তথ্য সংগ্রহ করেছেন।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, নাৎসি জার্মানির আক্রমণের হুমকির মুখে, ১৯৪০ সালের জুলাইয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ‘স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (এসওই)’ চালু করেন। এই গোপন সংস্থা শত্রু-অধিকৃত ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে যে-কোনও উপায়ে অনিয়মিত যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করত। ‘এসওই’ ১৯৪২ সালে নারী-নিয়োগ শুরু করে। যদিও প্রথম নারী বিশেষ এজেন্ট ক্রিস্টিনা স্কারবেক (পরবর্তীতে ক্রিস্টিন গ্রানভিল নামে পরিচিত) ১৯৩৯ সালের শেষের দিকেই শত্রু অঞ্চলে কাজ করছিলেন। মোট ৭৫ জন নারী বিশেষ এজেন্টকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অন্যান্য অধিকৃত দেশে আকাশ ও সমুদ্রপথে পাচার করা হয়েছিল। সেখানে তাঁরা স্থানীয় প্রতিরোধকে অর্থ, অস্ত্র, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগের মাধ্যমে সহায়তা করতেন। পুরুষ সহকর্মীদের মতোই তাঁদের ফিটনেস, ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশন, সাবোটাজ, ছোট অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। নারীরা শীঘ্রই সামরিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, পাচার, অস্ত্র সরবরাহ, পালানোর রুট তৈরি, শত্রু পরিবহণ ও যোগাযোগ বিঘ্নিত করার কাজগুলি করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধেও সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধ এবং সক্ষমতা সম্পর্কে লিঙ্গভিত্তিক প্রত্যাশার কারণে নারীরা সাধারণত শত্রু-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন। তবুও, ধরা পড়ার পরিণতি তাঁদের জন্যও সমান ভয়াবহ ছিল— ১৬ জন নারী এজেন্ট ফিরে আসেননি। বলা যেতে পারে, মিত্রশক্তির যুদ্ধ প্রচেষ্টা ও চূড়ান্ত বিজয়ে তাঁদের সেবার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
প্রযুক্তি ও অস্ত্রের উন্নতির সঙ্গে শীতল যুদ্ধ (কোল্ড ওয়ার)-র সময় গোয়েন্দা কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। নারীরা টাইপিস্ট, অনুবাদক, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং এমনকী, অপারেটিভের মতো প্রশাসনিক ভূমিকায় কাজ করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত সিআইএ নারী নিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চপদে তাঁদের অগ্রগতি ছিল সীমিত। শীতল যুদ্ধ (কোল্ড ওয়ার)-র সময় এলিজাবেথ বেন্টলি এবং কেমব্রিজ ফাইভ স্পাই রিং-এর মতো ব্যক্তিত্বরা উঠে আসেন।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য নারীরা প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোয় নেতৃত্বের পদে পৌঁছেছেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, লিঙ্গভিত্তিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের এখনও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ এবং কুসংস্কারের মুখোমুখি হতে হয়। জিনা হ্যাস্পেল সিআইএ-র প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, কীভাবে ছোট-বড় ভূমিকায় তাঁরা প্রথাগত চিন্তাভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, বাধা ভেঙেছেন এবং অন্যদের জন্য পথ প্রশস্ত করেছেন।
অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতের আগে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে নারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ খুব কম আছে। কারণ, সামাজিক বাধা নারীদের চলাফেরা ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত রেখেছিল। এসব তাঁদের এই ধরনের ভূমিকায় অংশগ্রহণে বাধা দিত।
লেখক: ভাস্কর মজুমদার
ফুয়াদ