
কোরবানী শব্দের অর্থ ত্যাগ, আত্মোৎসর্গ; নৈকট্য লাভ। পরিভাষায় কোরবানী হলো, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট জন্তু জবাই করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: " সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি (আল্লাহ) কোরবানীর বিধান দিয়েছি, আল্লাহ তাদের জীবন উপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে "(সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)।
কোরবানীর মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে চলে আসা একটি ইবাদত; যা মূলত স্রষ্টার উদ্দেশে সৃষ্টির নজরানা। ত্যাগ বা বিসর্জনের ঈদ হলো ঈদুল আজহা তথা কোরবানীর ঈদ। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানীর মধ্যে মানুষের জন্য শেখার অনেক কিছু রয়েছে। পশু কোরবানীর মধ্যে স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজের ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসাকে বিসর্জন দেয়ার উত্তম শিক্ষা রয়েছে। আপন নফসের আমিত্ব, অহঙ্কার ও বড়াইকে বিসর্জন দেয়ার হাকিকত হলো কোরবানীর। নিজের আমিত্বকে কোরবানীর করার অর্থই হলো, নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হিংসা, বিদ্বেষ, কাম, ক্রোধ, লোভকে বর্জন করা। কোনো কিছু বিসর্জনের যে আনন্দ, এর মধ্যে চিরস্থায়ী সুখ ও সাফল্যে থাকে। যে বা যারা নিজের নফসের কোরবানীর করতে পেরেছেন, তারা পরিশুদ্ধ হয়েছেন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়েছেন। নিজের আমিত্বকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোরবানীর করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মা পরিশুদ্ধ হবে না। আল্লাহর দিদার লাভ করাও সম্ভব হবে না।
নফসের তাড়নায় মানুষ নানাবিধ অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। এসব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকাই হলো নিজের আমিত্বের কোরবানী। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে এর গোশত কিংবা রক্ত পৌঁছায় না; বরং তাঁর দরবারে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছায়।’ (সূরা হাজ্জ : ৩৭)।
শুধু পশু জবাইয়ের মহোৎসবের নাম কোরবানী নয়। কোরবানীর হুকুম পালনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। কোরবানীর পশুর গোশত সমান তিন ভাগে ভাগ করার মধ্যে অনেক বড় ধরনের নৈতিক শিক্ষা রয়েছে। ধনীর সম্পদের ওপর যেমন গরিব মানুষের হক রয়েছে। তেমনি কোরবানির পশুর গোশতেও গরিব, দুঃখী ও দুস্থ মানুষের হক রয়েছে। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর কোরবানীর উটকে আমি তোমাদের আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো, যখন কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদের খেতে দাও ' (সূরা হাজ্জ : ৩৬)।
কোরবানীর পশুর গোশত পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে বিলি বণ্টনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির শিক্ষা রয়েছে। গরিব দুস্থ মানুষের সেবা করা ও মেহমানদারিতা হজরত রাসূল সা:-এর সুন্নত। কোরবানীর পশুর গোশত দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করার মাধ্যমে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ তথা পারস্পরিক মমত্ববোধ তৈরি হয়। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
একটি পশু কয়েকজন মিলে কোরবানী দেয়ার মধ্যে সামাজিকভাবে আত্মবিসর্জনের শিক্ষা রয়েছে। একটি পশু কয়েকজনে মিলে কোরবানী করতে হলে, সবার মন চিন্তা ও বিবেচনা এক হতে হয়। এখানে ইসলামের উদারতার বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
সংক্ষেপে কোরবানির ইতিহাস
মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল (রা.) ও কাবিল। বাবা আদম (আ.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর নামে কোরবানি করো, যার কোরবানি কবুল হবে, তার দাবি গ্রহণযোগ্য হবে।’ অতঃপর তাঁরা উভয়ে কোরবানি দিলেন। হাবিল (রা.)-এর কোরবানী কবুল হলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানী করেছিল, তখন একজনের কোরবানী কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানী কবুল করেন" (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)। এতে প্রতীয়মান হয়, কোরবানী কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোকদেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
ইতিহাসে কোরবানি
কোরবানীর ইতিহাস পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে: ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম, অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী? সে বলল, “হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন , তখন আমি (আল্লাহ) তাকে ডাক দিয়ে বললাম: “হে ইবরাহিম! আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন!” এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানীর বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখে দিলাম। ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা" (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)।
আমাদের কোরবানি
আজকের মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রথা চলমান আছে, এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? এটা কোথা থেকে এসেছে? প্রিয় নবী (সা.) উত্তরে বললেন, ‘এটা হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত বা আদর্শ। এই আদর্শকে অনুসরণের জন্যই আল্লাহ পাক তোমাদের ওপর কোরবানী ওয়াজিব করেছেন।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? উত্তরে মহানবী (সা.) বললেন: ‘কোরবানীর জন্তুর প্রতিটি পশমে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।’
কোরবানির উদ্দেশ্য
প্রত্যেক মানুষ ইবাদত করবে শুধু তার মহান মালিক আল্লাহ তাআলার জন্য , মোমিন বান্দা তার কোনো ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করবে না। অর্থাৎ ইবাদত হতে হবে সকল প্রকার শির্কমুক্ত, শুধু এক আল্লাহর উদ্দেশে। মহান রাব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে সে শিক্ষাই দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: ‘বলুন: নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত" ( আল কোরআন)
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, কোরবানি শুধু আল্লাহর উদ্দেশেই হতে হবে। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশে নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য-চেহারা এবং ধনসম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। সুতরাং, কোরবানির পূর্বেই কোরবানিদাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে।’
কোরবানির বিধান
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এখানে সুন্নত অর্থ তরিকা বা পদ্ধতি, আদর্শ বা অনুসৃত বিষয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: ‘ফা ছাল্লি লিরাব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার, আয়াত: ২)। এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কোরবানি একটি ওয়াজিব (আবশ্যিক) বিধান।
কোরবানি যার ওপর ওয়াজিব
কোরবানির তিন দিনে (১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত) যার নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এ উভয়ের যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তাহলে তার ওপর কোরবানী করা ওয়াজিব। হাদিস শরিফে আছে, কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আর নেই।
কোরবানির শিক্ষা
আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কোরবানিকে পরবর্তী মানুষের জন্য অনুসরণীয় করে দেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে এবং শিখতে পারে যে, অর্থ-সম্পদ, টাকাপয়সা, আল্লাহর রাস্তায় কীভাবে ব্যয় করতে হয়। এমনকি প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও যেন মানুষের কোনো দ্বিধা, সংশয় না থাকে।
কোরবানী আত্মত্যাগের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। মানুষের ষড়্রিপু তথা হিংসা, লোভ, কাম, ক্রোধ, ত্যাগের মাধ্যমে মনের পশুবৃত্তি তথা কুপ্রবৃত্তিকে জবাই করতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে ধনলিপ্সা, লোভ-লালসা, জাগতিক কামনা-বাসনা এবং দুনিয়াপ্রীতিকে কোরবানি করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জন করা কোরবানীর শিক্ষা।
কোরবানীর পশুর গোশত দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করার মাধ্যমে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ তথা পারস্পরিক মমত্ববোধ তৈরি হয়। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
কোরবানীর গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিবদের মাঝে বিতরণ করা সুন্নত ও অতি উত্তম আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: সে প্রকৃত মোমিন নয় যে নিজে পেট পুরে খায়; কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে (তিরমিজি)।
কোরবানির উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়। কোরবানি হলো আত্মবিসর্জন। সুতরাং সমাজের চলমান অশান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার ক্ষেত্রে কোরবানির শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। কোরবানীর শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজে লাগাতে পারলে সমাজের চেহারা পাল্টে যাবে।আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জিন্দেগি কল্যাণকর হবে। সুখী সমৃদ্ধ, কল্যাণকামী সমাজ, ও রাস্ট্র গড়ে উঠবে।
নোভা