
আসছে জাতীয় বাজেটে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য এই ঋণ নেওয়া হবে। সরকার বৈদেশিক ঋণের নির্ভরতা কমিয়ে আনার জন্যই অভ্যন্তরীণ খাতের ওপর জোর দিচ্ছে। বিগত সরকার ১৫ বছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়। অপরদিকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার তার গত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি মাসে গড়ে ৪০৩ মিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে। এতে করে প্রতি মাসে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে ৪,৮৪২ কোটি টাকা ঋণী হয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিদিনের হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ ১৬১ কোটি টাকার বেশি। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২৪২.৫৬ শতাংশ। ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বেড়েছে ২৮৩.৪৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে যখন প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, ওই বছর সরকার আসল ও সুদ বাবদ ঋণ পরিশোধ করেছিল ৮৭৫.৫৮০ মিলিয়ন ডলার। যা ১৫ বছরে বেড়ে হয়েছে ৩.৩৫৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ১৫ বছরে আসল পরিশোধ বেড়েছে ১৯৩ শতাংশ, আর সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৬০৯ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ৬৮৫.৭৪০ মিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছরে আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২.০০৯ বিলিয়ন ডলার।
বিদেশি ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি ঋণের চাপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ঋণ পরিশোধে অর্থ সংকটে রয়েছে সরকার। পুরানো ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে নতুন ঋণ নিতে হচ্ছে, যা আগামীতে আরও সংকট তৈরি করবে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি না থাকলে পরিশোধ নিয়ে এত উদ্বেগ থাকত না। অথচ ঋণের তেমন প্রতিফলন নেই জনজীবনে। মাতৃমৃত্যুর বৃদ্ধি, গড় আয়ু কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে আর্থসামাজিক উন্নয়নেও তেমন কোনো অবদান নেই এসব ঋণের। বরং ব্যক্তি খাতের বিদেশি ঋণের অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে, যা এক ধরনের প্রতারণামূলক বাস্তবতা।
বিদেশি ঋণ দরকার। তবে ব্যয়ের বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। মান এবং ব্যয়ের বিষয়ে আরও খেয়াল করতে হবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় মূল্যায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। সুতরাং বেশি ব্যয় কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয়। বড় প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নে রাশিয়া ছাড়া আর কেউ ঋণ দিতে রাজি হয়নি। প্রকল্পটিতে ঋণের বিপরীতে সুদের হার শুরুতে ৫ শতাংশ ছিল। এখনো একই হার বহাল আছে।
স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের কারণে বিপজ্জনক পথে রয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ঋণের সুবিধা সে দেশের সেবা খাতে যথার্থভাবে যুক্ত হয়নি। বাংলাদেশেও এমন ঋণ বাড়ছে। তবে এখন কমে আসছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে ভালো অবস্থানে ছিল। কারণ তখন এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণের বিষয় ছিল না, যা বিগত সরকারের সময় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঋণসংক্রান্ত আলোচনায় অদক্ষতা এবং দুর্নীতির বিষয় ছিল গত সরকারের সময়। মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে, যা ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে ঋণকে পুঁজিতে পরিণত করতে তেমন কিছু করা হয়নি।
বিদেশি ঋণের ফাঁদ নিয়ে কথা হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতি এড়াতে ঋণ নেওয়ার আগে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত ছিল, এসব ঋণের আসলেই প্রয়োজন ছিল কিনা। মানসম্পন্ন ব্যবহার করতে পারা যাবে কিনা। এ কারণে বিদেশি ঋণের অনেক অপচয় হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার কথা মনে করিয়ে দেয়। নীতির দুর্বলতা এখানে বড় বিষয়। এ দুর্বলতা দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। শুধু কথাই বলা হবে।
বিগত বছরগুলোতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে। ফলে খাতভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ঋণের মাধ্যমে উন্নয়ন জনজীবনে প্রতিফলিতই যদি না হয়, তাহলে অর্থ গেল কোথায়। বিদেশি ঋণের প্রবাহ এবং মানসম্পন্ন ব্যবহারের সংকটের কারণে দায়দেনা পরিশোধে বড় ধরনের ধাক্কা আসছে। ২০২৬ সালে তা আরও প্রকট হবে ধারণা করা হচ্ছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়াবে, এটা ভাবা হয়নি। আজ যারা ২০-২৫ বছরের বয়সসীমায় রয়েছে, তারাই এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে।
উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পকে একটা পয়সাও ব্যয় করা যাচ্ছে না। আমরা প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে রয়েছি। অথচ বিদেশি ঋণ পরিশোধে সংকটকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অস্বীকারের মনোভাব দেখা গেছে। যারা নীতিনির্ধারণ করেন, তারা বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে পারেননি।
বিদেশি ঋণে অনেক বড় প্রকল্প নেওয়া হয়, অথচ দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং ব্যবহারে দুর্নীতি আছে, স্বচ্ছতা নেই। ঋণ ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে। অথচ সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না। ফলে ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে সরকারকে নতুন করে ঋণ নিতে হচ্ছে। পাবলিকলি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ পরিশোধের জন্য ঋণ নিচ্ছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে। গত ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বর্তমানে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। তবে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মোট ঋণে রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, বাড়ছে বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্ত আরও কঠোর হচ্ছে। বিশেষত জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা যে হারে বাড়ছে, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ঋণ ব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সময় যত কমে আসছে, ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বিষয়টি। কারণ উত্তরণের পর আর বর্তমানের মতো নমনীয় সুদের হারে বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে না। এখন সতর্ক হওয়া এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য যে দুটো খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়- একটা ঋণ যেটা বৈদেশিক ঋণ, সেটা বৈদেশিক মুদ্রাতেই পেমেন্ট করা হয়। হয়তো এভাবে চিন্তা না করে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করা যায়। বৈদেশিক ঋণের একটা বিষয় হচ্ছে যে যত বেশি বৈদেশিক ঋণ তার মানে আমার তো স্বাভাবিকভাবে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে ডলারে। যদি আমাদের মুদ্রার মান খুব ভালো/স্ট্রং না হয়, যত দিন যাবে তত কিন্তু এই ঋণের বোঝা আমার বাড়তে পারে। ঋণগ্রস্ত জাতি হিসেবে অর্থনীতিতে ঋণ বাড়তে থাকবে। এটা কখনই শুভ লক্ষণ নয়। এটা স্বাভাবিকভাবেই সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে।
অভ্যন্তরীণ ঋণের বিষয়টি হচ্ছে সরকার যখন অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রভাব কমে যাচ্ছে। অলরেডি আমাদের কিছু সংকট আছে। সেখানে যদি ব্যক্তি খাতে ঋণ আরও কমে যায়, সেটা কিন্তু ব্যক্তিগত বিনিয়োগের জন্য ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, যেটা নেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে ব্যাপারটা, সেটা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। সে কারণে ঘাটতি যখন থাকবে অর্থাৎ ঋণ যখনই নেবে, তখনই সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হবে। মূলত বৈদেশিক ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সহনীয় ঋণ নেওয়াই উত্তম।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল