ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

ভারতের পানি ভাবনা এবং বাংলাদেশ

জুবায়ের হাসান

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

ভারতের পানি ভাবনা এবং বাংলাদেশ

বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত ৫-৬ জানুয়ারি ভারত সফর করেছেন। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সফরটি সংঘটিত হয়। তারপরও জ্যাক সুলিভানের সফরকে ঘিরে যথেষ্ট আলোচনা ছড়িয়েছে। দুদিনের ওই সফরে জ্যাক সুলিভান ভারতীয় প্রতিপক্ষ অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সফরে ভারতের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজি, মহাকাশ প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, সেমিকন্ডাক্টর, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, সাইবার, মেরিটাইম সিকিউরিটি, সামরিক লাইসেন্সিং এসব ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়। সুলিভান-দোভালের মিটিং সম্পর্কে গত ৬ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে যে রিড আউট প্রকাশিত হয়, তাতে এসব আলোচ্য বিষয় উল্লেখ করা হয়। ওই রিড আউটে আরও বলা হয়, ২০২২ সালের ২৪ মে জাপানের টোকিওতে কোয়াড সম্মেলনের সাইডলাইনে মোদি-বাইডেন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আইসেট (ইনিসিয়েটিভ অন ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজিস) বিষয়ে বাইডেন-মোদি যে অঙ্গীকার করেছিলেন, জ্যাক সুলিভানের এই সফর সেই ধারাবাহিকতায় হয়েছে। যাহোক, মার্কিন জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে ভারতীয় কোম্পানি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্সের পার্টনারশিপ স্থাপনের আলোচনা অনেকদিন ধরে চলছে। এছাড়াও এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার কথাও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের চেয়ারে বসে এসব বিষয় কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আইসেট, কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক এসবের ভবিষ্যৎ কি হবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কেননা, বাইডেনের নীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের ভারত সফর উপলক্ষে বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রচার তরঙ্গ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলেছিল। দু-চারটি পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল, ভারত যাচ্ছেন মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলিভান, আলোচনায় উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। এমন খবরের সূত্র হিসাবে ভারতীয় পত্রপত্রিকাকে উদ্ধৃত করা হয়। কিন্তু ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলো খবরটি ছেপেছিল আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে। বাস্তবে সুলিভানের ভারত সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কোনো প্রকার আলোচ্যসূচিতেই ছিল না। হোয়াইট হাউসের সরকারি ওয়েবসাইট সুলিভান-দোভালের বৈঠক সম্পর্কে গত ৬ জানুয়ারি রিড আউটের পাশাপাশি একটি ফ্যাক্টশিটও প্রকাশ করে। সেখানে সুলিভান-দোভাল বৈঠক সম্পর্কে একটি দীর্ঘ বর্ণনা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কোনো তথ্য উল্লিখিত হয়নি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি, নিউ দিল্লি) জ্যাক সুলিভানের জন্য একটি বক্তৃতামালার অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ওই বক্তৃতামালা অনুষ্ঠানের ব্যানারহেডের নাম দেওয়া ছিল, এ নিউ ফ্রন্টিয়ার ফর দ্য ইউএস-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ। এতে জ্যাক সুলিভান যে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন, সেখানেও বাংলাদেশের কথা কোনোভাবেই উচ্চারিত হয়নি। বস্তুত বাংলাদেশকে ভয় দেখানো ও ভড়কে দেওয়ার জন্যই ভারতীয় পত্রপত্রিকায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল যে, সুলিভান-দোভাল বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও থাকবে। ইতোপূর্বে গত নভেম্বরে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুলসী গ্যাবার্ডকে ঘিরেও বাংলাদেশকে ভয় দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল।
হাসিনা আমলের অভ্যাস ও প্রথা ছিল, মার্কিন কোনো বড়কর্তা দিল্লি এলে তিনি ঢাকা ঘুরে যেতেন। কিন্তু এবার জ্যাক সুলিভান দুদিনের সফর শেষে দিল্লি থেকেই ফিরে গেলেন। বাংলাদেশে ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের পর জো বাইডেন ৫ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে এক প্রকার বৈধতা দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ল্যু-বাইডেন জমানার দিন শেষ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন থেকে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতকে দূরে রাখবে। তা যে প্রশাসনই হোয়াইট হাউসের ক্ষমতায় বসুক না কেন। যুক্তরাষ্ট্র আর ভায়া দিল্লি হয়ে ঢাকাকে দেখবে না, বরং সরাসরিই যোগাযোগ রাখবে। এর প্রমাণ দিল্লি সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২৪ ডিসেম্বর জ্যাক সুলিভান নিজেই ড. ইউনূসকে ফোন করেছিলেন। ইউনূস-সুলিভান ফোনালাপ সম্পর্কে হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট একটি রিড আউট (বিবৃতি) প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, জ্যাক সুলিভান সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সেই সঙ্গে নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কার বিষয়ে ডক্টর ইউনূসের গৃহীত পদক্ষেপ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। ড. ইউনূস-সুলিভান ফোনালাপ এটাই ইঙ্গিত করে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতীয় ডেস্ক থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোও ভারতীয় আয়না ও চশমায় বাংলাদেশকে দেখার ইতি টেনেছে। গত ৯ ডিসেম্বর ডক্টর ইউনূসের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের একযোগে বৈঠক সেটারই লক্ষণ।
জ্যাক সুলিভানের ভারত সফরের অন্যতম একটি কারণ ভারতের পানি ভাবনা। এ সম্পর্কে জগৎবিখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্স গত ৪ জানুয়ারি একটি খবর ছেপেছে। যার শিরোনাম হলো, ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার টু ডিসকাস চাইনিজ ড্যাম ইন ইন্ডিয়া। নদীর উজানে চীন বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ভারতীয় অসুবিধা ও আপত্তিগুলো মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে চায় ভারত। ভারত পানি ভাবনা নিয়ে তার নীতিগত অবস্থানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈকট্য লাভ করতে চায়। উজানে চীনা বাঁধ নির্মাণে পরিবেশ ও জলবায়ুর যে ক্ষতি সাধন হবে এবং ভাটির দেশ হিসাবে ভারত যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে, তা প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন চায়। অতএব সুলিভানের সফরে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো প্রসঙ্গই ছিল না। বস্তুত বাংলাদেশকে এতদিন ভয় দেখিয়ে বশ করার লোভ সামলাতে না পারার কারণেই ভারতীয় পত্রপত্রিকা সুলিভানের ভারত সফরের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ জুড়ে দিয়েছে কল্পিতভাবে।
আমাদের দেশে যা ব্রহ্মপুত্র নদ নামে পরিচিত, তা চীনের তিব্বতে ইয়ারলুং জাংবো নদ হিসাবে পরিচিত। এই নদ মূলত চীনের মেকং অঞ্চল হতে শুরু হয়ে চীনের তিব্বত থেকে ভারতের অসমে প্রবেশ করেছে এবং পরে অসম থেকে কুড়িগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এ নদের উজানে চীন ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছে। এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বার্ষিক ৩০ কোটি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাই হবে পৃথিবীর বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
কমন বা অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশের সমান অধিকার থাকে। এটাই হলো আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি। এই সরল বোধটা ভারতের তরফ থেকে এতদিন উপেক্ষিত থেকেছে। কিন্তু এখন চীনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভারত নিজেই পানির আবদার ও অধিকারের কথা তুলছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গত ৩ জানুয়ারি সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে চীনা বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি। অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে ভাটির দেশেরও কিছু অধিকার আছে। রাজনৈতিক ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে সেই অধিকারের কথা বারবার চীনা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সেই অধিকার ও স্বার্থের বিষয়ে ভারতের পর্যবেক্ষণ জারি আছে। পরিস্থিতির ওপর ভারত নজরও রাখছে। সরকার সেই মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করবে।
তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদের ওপর বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে ভারত যতই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা জানাক না কেন, বাস্তবে চীনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার সম্ভাবনা নেই। চীন এটা নির্মাণ করেই ছাড়বে। সুতরাং পানি নিয়ে ভাবনা, আর না আর না, এমন আনন্দ গান ভারতীয় মন থেকে বিলীন হয়ে যাবে। এতদিন শুধু বাংলাদেশই পানির অভাবে দুর্ভোগে পড়েছে। এখন সেই কাতারে ভারতও যুক্ত হতে যাচ্ছে। এখানে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেননা, ভারত এখন নিজেই ভাটির দেশের ন্যায্য পানি পাওয়ার অধিকারের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। অতএব, সেই সূত্রে ভাটির দেশ হিসাবে ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির হিস্যায় বাংলাদেশেরও ন্যায্য অধিকার আছে। এখন বাংলাদেশ তার নদীর পানির সমান ও ন্যায্য ভাগীদারের কথা আরও জোরেশোরে তুলতে পারে। আর ভারত-চীন পানি বণ্টন আলোচনায় বাংলাদেশেরও শামিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হয়েছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×