ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

টরন্টোর চিঠি

সুখে থাকার মন্ত্র

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:০০, ২১ মে ২০২৪

সুখে থাকার মন্ত্র

বাঙালিরা ভালো থাকায় ভীষণ অপটু

কখনো খেয়াল করে দেখেছেন যে আমরা বাঙালিরা ভালো থাকায় ভীষণ অপটু। শৈশব থেকে দেখে এসেছি আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আমার অভিভাবকদের ফোনালাপের বিষয়বস্তু কে কতটা মন্দ আছেন সে বিষয়ে। কাউকে ফোন করে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করলে, ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি কতটা মন্দ আছেন সেটি ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।

কেমন আছেন এই প্রশ্নের উত্তরে কেবল ভাল আছি এতটুকু বলতে অপারগ। ‘আর বলবেন না ভাই, একদম ভালো নেই’, ‘ছেলেটা স্কুলে যেতে চায় না’, ‘মেয়েটার চলন-বলন বুঝি না’, ‘আমার শরীরটা বিশেষ সুবিধের না, ডাক্তাররাও কিছু ধরতে পারছেন না’, ‘আরে দেশের এই অবস্থায় কী আর ভালো থাকা সম্ভব?’, ‘বাজারের হাল-হকিকত দেখেছেন?’ মানে কারণ যাই হোক না কেন, বাঙালিরা ভালো নেই।

বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবেই ভালো নেই। ইতিহাসবিদরা নিশ্চয় ভালো করে বলতে পারবেন এর ব্যুৎপত্তি কোথায়, কিন্তু ঘটনা যে সত্য, তা পাঠক মাত্রই জানবেন। আমরা ভালো থাকতে জানি না, আমাদের ভালো থাকতে শেখানো হয়নি। ছোটকালে আমরা একটু হাসি-খুশী থাকলে আমাদের অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলা হয়েছে ‘এত হাসাহাসির কী হলো?

পড়ালেখা নেই?’ আমরা এও শুনেছি বেশি হাসলে বেশি কান্না বলে গেছেন রাম-সন্যাস! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদেরকে না হাসতে বলা হয়েছে, বলা হয়েছে এত হাসা ঠিক না, মেয়েদের বলা হয়েছে শব্দ করে হাসা অভদ্রতা; কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে যে হাসিকে সর্বোত্তম ওষুধ বলা হয়েছে, তা আমাদের জানানো হয়নি। খেয়াল করে দেখুন পশ্চিমা বিশ্বের শিশুরা বড় হওয়ার সময় শেখে- ‘Happiness shared is happiness doubled', 'True happiness can be found in the tiniest of things', 'Choose life, choose happiness, and make someone smile', wKsev 'Our days are happier when we give people a bit of our hearts.', A_ev 'Happiness is free, but priceless.’ অর্থাৎ শৈশব থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের শিশুদের শেখানো হয় হাসতে হবে, হাসিখুশী থাকতে হবে। জীবনে দুঃখ-বেদনা-ব্যর্থতা যাই আসুক না কেন, তা যেন মানুষের মুখের হাসিকে কেড়ে নিতে না পারে। 
এই গ্রীষ্মে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ‘Issues in Child Health and Development’ শীর্ষক একটি কোর্স পড়াচ্ছি অনার্সের শিক্ষার্থীদের। সেখানে শিশুদের জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বেড়ে ওঠাকালীন সময়ে তাদের মস্তিষ্কের গঠন কীভাবে হয়, কেন হয়; তাদের বেড়ে ওঠায় জিনের প্রভাব, পরিবারের ভূমিকা সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়।

ফ্রয়েডের সাইকোসেক্সুয়াল থিওরি থেকে ডিভোর্সি বাবা-মায়ের শনি-রবিবার শিশুকে সময় দেয়ার বিষয়সহ অনেক কিছুই থাকে আমার ক্লাসের আলোচনায়। আমার ছাত্রদের বলি অনেক সময় আমরা মনে করি আমাদের পুবের ঐতিহ্যে বাবা-মা-সন্তানদের একসঙ্গে থাকা বেড়ে ওঠাকে একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমরা কেবল একসঙ্গেই থাকি, যথাযথ দায়িত্ব পালন করি না।

শিশুদের মননশীলতার পেছনে কতটা সময় দিই আমরা? শিশুদের স্কুলে নেই, একের পর এক প্রাইভেট টিউটরের কাছে নেই, নাচ-গান-ছবি আঁকা শেখাই, জুডো-কারাতে-ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে গেটের বাইরে বসে থাকি বছরের পর বছর – উদ্দেশ্য ছেলেমেয়ে বিরাট কিছু হবে, আমরা আত্মীয়স্বজনের কাছে বড়াই করে বলতে পারব। এই করতে করতে শিশুর নিজের, সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের জীবনও শেষ।

এই অভিভাবকরা সন্ধ্যা-রাতে অন্যদের সঙ্গে ফোনালাপে ক্রমাগত বলতে থাকেন, আরে ভাই বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করতে করতে জীবন শেষ হয়ে গেল, নিজের জন্য কোনো সময় পাই না। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি আমাদের শিশুরা এই ঘোড়দৌড়ে থাকতে চায় কিনা।

পশ্চিমা বিশ্বে দেখছি, বাবা-মা ডিভোর্স নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন, কিন্তু শনি-রবিবার ঠিকই দায়িত্ব ভাগ করে সন্তানকে পার্কে নিয়ে যাচ্ছেন, সন্তানের সঙ্গে লেকের ধারে বসে নিজেদের বানানো স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন, ডাউনটাউনে আইস্ক্রিম খেতে খেতে উন্ডো শপিং করছেন। বোর্ড গেইম বলে একটা জিনিস এখানে খুব জনপ্রিয়।

শুক্রবার রাতে ডিনার শেষে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে কোনো একটা খেলা খেলে, এতে করে এদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসাও বাড়ে। বেশিরভাগ সময় এরা একসঙ্গে ডিনার করে, সেখানে কিছু গৎবাঁধা প্রশ্ন থাকেÑ যেমন কার সারাটা দিন কেমন গেল? এতে করে নিজেদের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস হয়, আর পারিবারিকভাবে সবাই সবটা জানতে পারে যে, কার জীবনে কী ঘটছে।

আমাদের দেশে বাবা-মা আর সন্তানের মধ্যে থাকে চরম গোপনীয়তা। কেউ কাউকে কিছু বলে না, সারাটা দিন কেমন গেল সেই প্রশ্ন করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই সারাদিন সন্তানকে মানুষ করার যুদ্ধটা ঠিকঠাক করার পর তাদের কেউ কেউ হয়তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যবসায়ী হিসেবে উতরে যায়; কিন্তু বাবা-মা-ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা থাকে না।

আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো নিজের মধ্যে নানারকম জটিলতা, অসুখ নিয়ে বেড়ে ওঠে। যার অন্যতম ভালো না লাগার অসুখ। আমাদের চারপাশে দেখবেন ভালো না লাগার, ভালো না থাকার অসুখ। কেউ কাউকে আপনি তো ভালো আছেন বললে ওই ব্যক্তি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রমাণ করেই ছাড়বেন যে তিনি ভালো নেই। শারীরিক অসুস্থতা যে গর্ব করার কোনো বিষয় নয়, সেটি আমাদের বোঝানো খুব কঠিন।

আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলার সময়, মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা, ঘুম হয় না, হজম হয় না, খেতে ভালো লাগে না– নানা সমস্যা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারি। অথচ রাত ২টা পর্যন্ত ফোনে কথা বললে, ফেসবুকিং করলে যে ঘুম হওয়ার কথা না – সেটি তাকে মনে করিয়ে দিলে আবার বিরাট বিপদ। কাউকে বলা যাবে না যে মানুষের জীবনে খাবার প্রয়োজন খুব সীমিত।

ছোট সন্তান আছে এমন বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে দেখেন তাদের মূল অভিযোগ ‘আমার বাচ্চা কিছু খেতে চায় না।’ আরে ভাই, ওর তো এত খাবার দরকার নেই। একজন মানুষের জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কত খাবার লাগে? এই যে দেশে থাকতে দেখতাম ভোরবেলা নাস্তা, ১১টার দিকে স্ন্যাক্স, ১টায় লাঞ্চ, ৩টায় হাই-টি, ৭টায় সন্ধ্যাকালীন নাস্তা, ১০টায় রাতের খাবার আবার রাত ১২টায় মধ্যরাতের স্ন্যাকস – এসব ভাবলে এখন শরীর গুলিয়ে আসে।

সারাদিন এত এত খাবার, এত তেল-মশলা, শরীর তো খারাপ করবেই। আমাদের ছুটির দিনের বিনোদন হচ্ছে পূর্বাচলে গিয়ে হাঁসের মাংস খাওয়া, পিজা হাটে বসা, বার্গারকিং এ মুরগির হাড় চাবানো। 
কোনদিন কাউকে বলতে শুনি না, এই ছুটির দিনে শিল্পকলা মঞ্চে নাটক দেখে আসলাম, কিংবা বেঙ্গল গ্যালারিতে একটা চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখেছি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটা সাহিত্য বিষয়ক আড্ডায় অংশগ্রহণ করেছি। এই যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষুধা সেটি যদি জাগিয়ে তোলা না যায়, তবে বাঙালির হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইবার কোনো জো নেই।

আনন্দের, সুখের, খুশীর উৎস তো মন, পাকস্থলী নয়। শিশুদের শুক্র-শনিবার তো কোচিং সেন্টারে কাটার কথা ছিল না; তাদের ছুটির দিন বইয়ের দোকানে ঘুরে, মাঠে খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে অলস আড্ডা দিয়ে কাটানোর কথা। আমরা সাফল্যের ঘোড়দৌড়ে ছুটতে গিয়ে শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়েছি, ধ্বংস করেছি আমাদের দাম্পত্য-যৌবন, তৈরি করেছি একটি অনুতাপে পূর্ণ ক্লান্ত বার্ধক্য। 
এখনো সময় আছে, সময় সবসময়েই থাকে, যদি আমরা তাকে রাখতে চাই। ঘোড়দৌড়টা থামান এবার। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখে, নিজের চোখে চোখ রেখে বলুন খুব ভালো আছি। সত্য না হলেও বলুন। সন্তানকে স্কুলে যাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে ভর্ৎসনা না করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলুন, শুভ সকাল বাবা, শুভ সকাল মা। আপনি জানেনও না শৈশবে বলা এই ছোট ছোট কথা কীভাবে বদলে দেয় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবন। 

২০ মে ২০২৪

[email protected]

×