ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ৮ মে ২০২৪

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি

পৃথিবীতে অব্যাহত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে

পৃথিবীতে অব্যাহত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে জীবজগতের। মানব জাতির জীবন বিলাসিতা এবং অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় বায়ুম-লে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশের এই দুর্দশা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অতিমাত্রায় পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পরিবেশের ওপর এই ক্ষতিকর দুর্যোগ নেমে আসে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদরা তখন থেকেই বায়ুম-লে কার্বনের পরিমাণ কমানোর জন্য জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। জিওইঞ্জিনিয়ারিং বলতে বোঝায় উদীয়মান প্রযুক্তির একটি সেট, যা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব রাখতে পারে। জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রচলিতভাবে দুটি বিস্তৃত বিভাগে বিভক্ত। প্রথমটি হলো, কার্বন জিওইঞ্জিনিয়ারিং- যা প্রায়ই কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ (সিডিআর) করা বোঝায়। অন্যটি হলো, সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং- যা সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনা (এসআরএম) অ্যালবেডো পরিবর্তন।

বড় পার্থক্য হচ্ছেÑ কার্বন জিওইঞ্জিনিয়ারিং বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্বের লিংকটি ভেঙ্গে দেয়, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস করে। আর সৌর জিওইঞ্জিনিয়ারিং সূর্যালোকের একটি ছোট ভগ্নাংশকে মহাশূন্যে প্রতিফলিত করতে বা গ্রহকে শীতল করার জন্য মহাকাশে ফিরে আসা সৌর বিকিরণের পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে। 
উল্লেখযোগ্য জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিগুলো হলো- (১) স্ট্র্যাটোস্ফেয়ারিক অ্যারোসল ইনজেকশন, যা আগত সূর্যালোকের বিরুদ্ধে প্রতিফলিত বাধা হিসাবে কাজ করার জন্য স্ট্রাটোস্ফিয়ারে (বায়ুম-লের ওপরের স্তর) প্রচুর পরিমাণে সালফার কণা (যেমন- সালফার ডাই-অক্সাইড) স্প্রে করাকে বোঝায়। এই প্রযুক্তিতে আর্টিলারি বন্দুক থেকে বা বিমানের পেছনের অংশ থেকে কণা (যেমন- টাইটানিয়াম বা অ্যালুমিনিয়াম) নিক্ষেপ করা, আকাশে বড় পায়ের পাতার মোজাবিশেষ ব্যবহার করা বোঝায়।

(২) সারফেস অ্যালবেডো পরিবর্তন- অ্যালবেডো হলো একটি পরিমাপ, যা একটি পৃষ্ঠকে আঘাত করে আলো শোষিত না হয়েই প্রতিফলিত হয়। জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে, অ্যালবেডো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ দ্বারা শোষিত সৌরশক্তির পরিমাণকে প্রভাবিত করে। তুষার এবং বরফের মতো উচ্চ অ্যালবেডোসহ পৃষ্ঠগুলো মহাকাশে ফিরে আরও সৌরশক্তি প্রতিফলিত করে, যা জলবায়ুর ওপর শীতল প্রভাব ফেলে। বিপরীতভাবে, কম অ্যালবেডোসহ পৃষ্ঠগুলো, যেমন- অন্ধকার বন বা মহাসাগর, বেশি সৌরশক্তি শোষণ করে, যা জলবায়ুর ওপর উষ্ণতার প্রভাব ফেলে। তাই অ্যালবেডোর পরিবর্তন মেরু বরফের ক্যাপ গলে যাওয়া বা ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনে পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

(৩) মেরিন ক্লাউড ব্রাইটনিং হলো, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবিলা করার জন্য একটি প্রস্তাবিত জিওইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল। এটি সামুদ্রিক স্ট্র্যাটোকুমুলাস মেঘ (সাধারণত মহাসাগরের ওপর) ক্ষুদ্র সামুদ্রিক জলের ফোঁটাগুলোকে প্রবর্তন করে আরও সূর্যালোক প্রতিফলিত করে। এই প্রতিফলন তাত্ত্বিকভাবে আগত সূর্যালোকের একটি ছোট অংশকে মহাকাশে ফেরত পাঠায় এবং দূষণের কণার কারণে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক শীতল প্রভাব তৈরি করে।

(৪) মাইক্রোবাবল- সাগরে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বায়ু বুদবুদ তৈরি করে সমুদ্রের আলোকে প্রতিফলিত করে, যা জলবায়ুর সামগ্রিক শীতলতা তৈরি করে। (৫) কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ (সিসিএস) সাধারণত বিদ্যুৎকেন্দ্র বা অন্যান্য শিল্প উৎস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের যান্ত্রিক ক্যাপচার বোঝায়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড সাধারণত ধোঁয়া থেকে নির্গমনের আগে ক্যাপচার করা হয়। তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড অতঃপর দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের জন্য ভূগর্ভস্থ জলে পাম্প করা হয়। ফলে ভূপৃষ্ঠের ওপরে তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকতে সহায়তা হয়।

(৬) ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচারÑ যা বাতাস থেকে সরাসরি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ বা অপসারণে কার্যকর। এই পদ্ধতিতে রাসায়নিক এবং যান্ত্রিক উপায়ে বায়ুম-ল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিষ্কাশন করা হয়। সাধারণত একটি রাসায়নিক সরবেন্ট এবং বড় ফ্যান ব্যবহার করে একটি ফিল্টারের মাধ্যমে বাতাস চলাচল করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড তখন সিসিএস বা ইওআর বা অন্যান্য ব্যবহারের জন্য গ্যাসের প্রবাহ হিসাবে পাওয়া যায়।

(৭) মহাসাগর নিষিক্তকরণ বলতে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার জন্য কম জৈবিক উৎপাদনশীলতাযুক্ত অঞ্চলে লোহা (চূর্ণ আয়রন সালফেট হিসাবে) বা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান (যেমন- ইউরিয়া) সমুদ্রে ফেলে দেওয়াকে বোঝায়। ফলস্বরূপ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বায়ুম-লীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে নিয়ে সমুদ্রের তলদেশে নিক্ষেপ করে বা মেরে ফেলে।

(৮)  কৃত্রিম আপওয়েলিং- এই পদ্ধতিও অনেকটা মহাসাগর নিষিক্তকরণের মতো। এখানে কৃত্রিমভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ গভীর সমুদ্রের জলকে পৃষ্ঠে পরিবহন করত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বায়ুম-লীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ ও সঞ্চয় করে। ফলে মৃত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বায়োমাস সমুদ্রের তলদেশে ডুবে  যায়।

(৯) বর্ধিত সালোকসংশ্লেষণÑ শ্যাওলা, ধান, গম, তুলা এবং গাছের মতো ফসলকে জেনেটিক্যালি এমনভাবে ম্যানিপুলেট করা হয়, যাতে তারা আরও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিপাক করতে পারে। (১০) অরবিটাল আয়না এবং সানশেডÑ এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর বায়ুম-লের বাইরে কয়েক মিলিয়ন ছোট প্রতিফলিত বস্তু স্থাপন করাকে বোঝায়। এই ঘনীভূত বস্তুর ক্লাস্টার আংশিকভাবে পুনর্নির্দেশিত বা আগত সৌর বিকিরণ ব্লক করতে পারে। বস্তুগুলো রকেট থেকে উৎক্ষেপণ করে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে একটি স্থিতিশীল ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্টে অবস্থান করে (ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্টগুলো হলো মহাকাশের বিভিন্ন অবস্থান)। এর কার্যকরী ভূমিকা হলো অন্তর্মুখী সৌর বিকিরণ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে বৈশ্বিক বায়ু তাপমাত্রা হ্রাস পাবে।

(১১) ক্লাউড-সিডিংÑতাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাচীনতম কৌশলগুলোর মধ্যে একটি হলো ক্লাউড সিডিং। এটি একটি আবহাওয়া  পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যা বৃষ্টি বহনকারী মেঘে সিলভার আয়োডাইড বা কঠিন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কণা বিচ্ছুরিত করে শুকনো কৃষি জমিতে বৃষ্টি আনার চেষ্টা করে। এই পদ্ধতিতে আকাশে বিদ্যমান মেঘগুলোকে আরও বৃষ্টি তৈরির জন্য প্রভাবিত করে। এটির জন্য উড়োজাহাজ দিয়ে সিলভার আয়োডাইডের ছোট ছোট কণা মেঘের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর খুব সহজেই জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পরিণত হয় বৃষ্টিতে। 
পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুম-লের কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানোর এই পদ্ধতিগুলো খুবই ব্যয়বহুল এবং বিতর্কিত। সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হলোÑ প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, বেশি করে গাছ লাগানো, জলাশয়, নদী এবং সমুদ্রের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা। এগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বন জাতীয় ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে মানুষসহ প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শুধু আমাজন বনই বছরে ৬০ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভূপৃষ্ঠ থেকে শোষণ করে। আর সমুদ্রগুলো বছরে ৩০০ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভূপৃষ্ঠ থেকে শোষণ করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সারা পৃথিবী যেখানে টেকসই উন্নয়নের পথে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে তথাকথিত উন্নয়নের নামে আমরা প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন, নদী ও জলাশয় ভরাট করে ইমারত বা ইটভাঁটি নির্মাণ করে পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছি। 
পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবনতি মানব জাতি ও সমস্ত প্রাণিকুলের জন্য কতটুকু হুমকিস্বরূপ, তা আমরা এখন বেশ টের পাচ্ছি। একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৬ শতাংশ। রাজধানী ঢাকায় বনভূমি বা গাছপালার পরিমাণ মাত্র ২ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে আরও কমে যাচ্ছে। অন্যান্য শহরও এর ব্যতিক্রম নয়।

গবেষকরা বলছেন, বিগত ১০০ বছরে বায়ুম-লের তাপমাত্রা দশমিক ৩ ডিগ্রি থেকে দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এই শতক শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে। তাই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গাছই হতে পারে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ, নীরব ও সাশ্রয়ী কা-ারি। একটি গাছ বছরে গড়ে  ২৬০ পাউন্ড অক্সিজেন নির্গত করে।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×