ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা

আবদুল খালেক

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা

বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির প্রাচীনত্ব নিরূপণ

বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির প্রাচীনত্ব নিরূপণ করার কাজটি মোটেই সহজ নয়। বিভিন্ন রকমের গবেষণার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে যে, প্রাচীনকালে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে আগে। আর সেই বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে উন্মেষ ঘটেছে বাঙালি জাতির। সে অর্থে বাঙালি জাতি নিঃসন্দেহে একটি ভাষাভিত্তিক জাতি। ভাষার জন্ম হয় মানুষের মুখে মুখে। সেই  মুখের ভাষা ধীরে ধীরে কোনো একপর্যায়ে লিখিত রূপ ধারণ করে। মৌখিক ভাষার মূল বাহন মানুষের ‘কণ্ঠ’। অপর দিকে লেখ্য ভাষার বাহন ‘লিপি’।

বলা হয়ে থাকে বাংলা লিপির মূল উৎস ‘অশোক লিপি’। সে বিচারে অশোক শাসনকালের আগেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়ে গেছে। কাজেই অনুমান করা যায় বাংলা ভাষা কয়েক হাজার বছরের পুরাতন ভাষা। বাংলা ভাষা যেমন পুরাতন, তেমনি  বাঙালি জাতিও হাজার বছরের পুরাতন এক ঐতিহ্যবাহী জাতি। অতি প্রাচীনকালে ‘বং’ ভাষাভাষী এক জনগোষ্ঠী যে এলাকায় বসতি স্থাপন করে, সেই এলাকা ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে ‘বং’ জনপদ হিসেবে।

‘বং’ জনপদের পাশাপাশি আরও কিছু জনপদ গড়ে উঠেছিল, যেমন- গৌড়, রাঢ়, কু-ু, সুম্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট ইত্যাদি। জনপদগুলোর  মধ্যে শক্তির লড়াই ছিল। সে লড়াইয়ে ধীরে ধীরে ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদের ওপরে আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়। কালের গতি ধারায় ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদকে একপর্যায়ে গ্রাস করে ফেলে। সেই ‘বং’ জনপদেরই বিবর্তিত রূপ ‘বংআল>বাংআল, বাংআলদেশ এবং সবশেষে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশ। একই ধারায় বংলাদের বংআল ভাষার বিবর্তিত রূপ বংআল ভাষা তথা বাংলাভাষা এবং বংআল জাতির বিবর্তিত রূপ বংআলি জাতি তথা বাঙালি জাতি।
অতীত ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বাংলাদেশের উর্বর মাটি বিদেশীদের কাছে ছিল অতি লোভনীয়। যে কারণে যুগ যুগ ধরে দেশটি বিদেশীদের হামলার শিকার হয়েছে। কতিপয় উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যায়। আনুমানিক নবম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ সেন শাসকদের দখলে ছিল। সেনেরা নিজেদের মাতৃভাষা সংস্কৃত ভাষাকে এ দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ মুসলিম শাসকদের দখলে ছিল।

মুসলিম শাসকরা নিজেদের ফারসি ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করে। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইংরেজদের দখলে ছিল। তখন ইংরেজি ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়।  ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি ঘটে। জন্ম লাভ করে পাকিস্তান নামের এক নতুন রাষ্ট্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলার মানুষ বিশ্বাস করেছিল এবার তারা স্বাধীন হয়েছে।

স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে যখন ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।

বাঙালি জাতি তার ভাষার প্রতি সবসময় আবেগপ্রবণ। নিজের  মাতৃভাষার অবমাননা এ জাতি কখনও সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি।  ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য এ দেশের মানুষকে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে। ভাষা শহীদদের  রক্তের দিকে তাকিয়ে বাঙালি জাতি নতুন করে আত্ম আবিষ্কারের চেষ্টা চালায়। প্রাচীন সেন শাসনকাল থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত বাঙালি জাতি  হাজার বছর ধরে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ ছিল।

সে কারণে  বাঙালি তার প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পায়নি বটে, তবে নিজের মাতৃভাষাকে বাঙালি জাতি সব সময় অন্তরে ধারণ করে রেখেছে। নিজেকে সব সময় পরিচয় দিয়েছে বাঙালি বলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হাজার বছরের বাঙালি পরিচয় বাদ দিয়ে তাকে পরিচয় দিতে হয় পাকিস্তানি জাতি বলে। তার মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলো না। হাজার বছরের বাঙালির জাতীয়তা হারিয়ে গেল।  তবে তার স্বাধীনতা থাকল কোথায়? তার মনে নানা প্রশ্ন। সে যদি বাঙালি, তবে তার রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে না কেন? অপরদিকে তার জাতীয়তা যদি পাকিস্তানি, সে ক্ষেত্রে উর্দুকে সে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে পারছে না কেন? তার মধ্যে দেখা দেয় মারাত্মক আত্মপরিচয়ের সংকট।

১৯৫২ সালে ভাষা শহীদের রক্ত বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৫৪ সালে গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার যে নির্বাচনী ইস্তেহার প্রচার করে, তার মধ্যে বাংলা ভাষার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়।  সেখানে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়, যুক্তফ্রন্ট রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে।

যে বর্ধমান হাউস থেকে  ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ  দেওয়া হয়েছিল, সেই বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করা হবে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ বিপুল ভোটের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা ষড়যন্ত্রের কারণে যুক্তফ্রন্ট রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।

১৯৫৮ সালে দেশে শুরু হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। আইয়ুব খান অস্ত্রের বলে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে সামরিক শাসনের সমস্ত আক্রোশ শেখ মুজিবের ওপর একে একে গিয়ে পড়তে থাকে। আইয়ুবের এক দশকের ঊর্ধ্বকাল শাসন আমলে শেখ মুজিব প্রায় আট বছর কারাগারে আবদ্ধ থাকেন। কোনো কোনো সময় তাঁর কারাবাসের মেয়াদ এক বছরের চেয়ে দীর্ঘায়িত হয়।

এ ছাড়াও অসংখ্য মামলা চাপিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হতে থাকে। কিন্তু এতে মুজিবকে দমানো যায়নি। যখনই তিনি মুক্তি পেয়েছেন, তখনই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং আইয়ুবীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ভাষণ দিয়েছেন। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। 
ছয় দফাকে একটু নিবিষ্টচিত্তে বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুভব করা যায় যে, এর মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বীজ শুধু লুকিয়ে নেই, তা অঙ্কুরিত হয়েছে। সুচতুর আইয়ুব খান ও অনুসারীগণ উপলব্ধি করলেন যে, শেখ মুজিবকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। অর্থাৎ তাঁকে ফাঁসিতে লটকাতে হবে।

এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি এস এ রহমানের নেতৃত্বে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে পঁয়ত্রিশজনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলার নামকরণ হয় মুজিব বনাম রাষ্ট্র।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ষাটের দশকের স্লোগানের ভাষা- তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা । তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, ‘জেলের তালা ভাঙবোÑশেখ মুজিবকে আনবো।’ স্লোগানের ভাষা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে ওঠে।  ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। শেখ মুজিব জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে এসে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিতে থাকেন।

১৯৭১ সালের  ৭ মার্চের এক ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণটি তিনি শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর  ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের পর পাকিস্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। জন্ম হয় ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশের। 


লেখক : অধ্যাপক, সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী

×