
.
১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথমপর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হতে থাকে। সর্বপ্রথম গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। এতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। গানটি হলো ‘শোনেন হুজুর, বাঘের জাত এই বাঙালিরা, জান দিতে ডরায় না তারা, তাদের দাবি বাংলা ভাষা, আদায় করে নেবেই।’ সেই থেকে শুরু ভাষা আন্দোলনের গানের। তিনি পরবর্তীকালে একুশে নিয়ে লিখেছেন ‘বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন, ভুলতে কি পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন’ এবং ‘বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা’।
আবদুল লতিফের লেখা ও সুরে কালজয়ী একুশের গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়’। গানটি লেখা হয়েছিল ১৯৫১ সালের শেষ ভাগে। তবে এটি সমাদৃত হয় বায়ান্নর পরে। যার কয়েকটি লাইন পরবর্তীতে আবদুল লতিফ পরিবর্তন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন মুকুল ফৌজের কর্মীদের নিয়ে প্রথম তিনি এই গানটি উপস্থাপন করেন। তারপর একে একে লিখলেন ‘বুকের খুনে রাখল যারা, মুখের ভাষার মান, ভোলা কি যায়রে তাদের দান?’, ‘আমি কেমন কইরা ভুলি, মুখের কথা কইতে গিয়া, ভাই আমার খাইছে গুলি’, ‘রফিক-শফিক-বরকত নামে, বাংলা মায়ের দুরন্ত কটি ছেলে, স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে, আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে’, ‘আবার এসেছে অমর একুশে, পলাশ ফোটানো দিনে, এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে’। সবকটি গানই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে। তখনো দেশটির নাম পাকিস্তান। তাই কাজটি খুব সহজ ছিল না এ কথা অনস্বীকার্য।
‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না, এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। ২১ নিয়ে সর্বপ্রথম এই গানটির রচয়িতা সাহিত্যিক ও ভাষা সংগ্রামী আ ন ম গাজীউল হক। গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন তারই অনুজ নিজাম উল হক। তিনি ‘দূর হাঁটো দূর হাঁটো, ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্থান হামারা হায়’ জনপ্রিয় এই হিন্দি গানটির সুর অনুসরণ করেছিলেন। গানটি ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে প্রথম শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রথম গাওয়া হয়। তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কালজয়ী গান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।’ চারণ কবি শামসুদ্দীন আহমেদ রচিত গানটি সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। গানটি গেয়েছেন রথীন্দ্রনাথ রায়। ইতিহাস মতে এটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান। বাগেরহাটের চা বিক্রেতা শামসুদ্দীন আহমেদ চা বিক্রি করতে করতে ২২ ফেব্রুয়ারি মুখে মুখে গানটি রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ ২১ তারিখের পরদিনই গানটি রচিত হয়েছিল।
১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরিতে গানটি গাওয়া হতো গাজীউল হকের আরেকটি একুশের গান। সেটি হলো হলো ‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে, তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’ এর আগে ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসের প্রভাতফেরিতে ভাষাসংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদের লেখা ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল, ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে’ গানটি গাওয়া হয়। এটিই মূলত প্রভাতফেরির প্রথম গান। তিনি গানটি ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে রচনা করেন; সুর দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এছাড়া কখনো প্রভাতফেরিতে বদরুল হাসানের লেখা আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে’ গানটিও বেশ গাওয়া হতো।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ খ্যাতিমান গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা গানটিতে প্রথম সুর দেন আবদুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে দেশবরণ্যে সুরকার আলতাফ মাহমুদের নতুন সুরে কালজয়ী গানটি একুশের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত করে। আকুল করা কথা আর ব্যাকুল করা সুরে একুশ পালন; শহীদ স্মরণে, প্রভাতফেরিতে, শহীদ মিনারে গানটি আমাদের চেতনার এক দীপ্রমশাল। তার একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান হলো : ১. ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা, ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা,’ ২. ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া, দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা’।
‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা, সেই থেকে শুরু, সেই থেকে শুরু, সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা’। গীতিকবির ভাষায় জাতির দিনবদলের পালা শুরু হয়েছিল যেদিন, যা আজও বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয়। এই গানটির গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সুর করেছেন অজিত রায়; গানটি প্রথম গেয়েছিলেন রফিকুল আলম। ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লেখা, সুরে ও কণ্ঠে গাওয়া গানটি আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি আবেদন সৃষ্টি করছে যুগ যুগ ধরে। তার সেরা গানের মধ্যে আরও হলো ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’! এবং ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা।’ ‘ও মা তুমি বলো না ওরা কেন শহীদ হলো, তুমি একুশ এলে ভাসো চোখের জলে আর কেন হও এলোমেলো।’ মোহাম্মদ মোজাক্কেরের কথায় সেলিম আশরাফের সুরে গানটি প্রথম গেয়েছেন কনকচাঁপা। যা শুনলেই আমাদের মধ্যে মা আর মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ বাড়িয়ে দেয় আরও কয়েক গুণ। মনে করিয়ে দেয় ভাষাসৈনিকদের আত্মদানের কথা।
‘আমাদের চেতনার সৈকতে, একুশের ঢেউ মাথা কুটলো, শহীদের রক্তের বিনিময়ে, চোখে জল কয় ফোঁটা জুটলো’। নাজিম মাহমুদের লেখা গানটি সুর করেছিলেন প্রখ্যাত সুরকার সাধন সরকার। তাদের আরও একটি বিখ্যাত গান হলো ‘কৃষ্ণচূড়া আর রক্ত পলাশের, রঙিন জালবুনে, একুশে এসো আজ শান্ত পায়ে পায়ে, নতুন ফাল্গুনে।’ ‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে, ধুধু বালু চরে, পাখিদের নীড়ে, তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা।’ গানটির লেখক কবি শামসুর রাহমান। খন্দকার নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন রুনা লায়লা। ‘এই ভাষাতেই স্বপ্ন দেখি, এই ভাষাতেই লিখন লিখিরে, এই ভাষাতেই মা-কে ডাকি জানাই প্রাণের ভালোবাসা।’ আবদুল লতিফের কথা ও সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া গানটি এখনো স্বমহিমায় মহিমান্বিত। ‘যে ভাষার জন্য এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম, সে ভাষায় আমার অধিকার।’ কবির সুমনের কথা ও সুরে এ গানে বাংলাকে বারবার ফিরে পাওয়া যায়; নতুন ছন্দে, নতুন কাব্যে, নতুন ভাবনায়।
‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অনন্য একটি গান। গানটি রচনা করেন ফজল-এ খোদা। সুর দেন প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবদুল জব্বারের কণ্ঠে গানটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। গানটি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে সর্বত্র পরিবেশন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর থেকে গানটি বেশি প্রচারিত হলেও মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণেই এটি রচিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতা মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে ১২তম অবস্থানে অন্তর্ভুক্ত হয় গানটি।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরও কিছু জনবহুল গান হলো ‘ঘুুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা, জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে ভোরের করুণ তারা’ (বদরুল হাসান)। ‘শহীদী খুন ডাক দিয়েছে, আজকে ঘুমের ঘোরে, আজ রক্তপথের যাত্রী মোরা, নতুন আলোর ভোরে’ (তোফাজ্জল হোসেন)। ‘রিক্ত শপথে আজিকে তোমারে স্মরণ করি, একুশে ফেব্রুয়ারি’ (তোফাজ্জল হোসেন)। ‘মিলিত প্রাণের কলরবে, যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’ (হাসান হাফিজুর রহমান)। ‘একঝাঁক পলাশের দুরন্ত রক্তে, রাজপথ জনপথ সিক্ত, শহীদের শপথেরা হৃদয়ের স্তম্ভে, দুর্জয় উন্মেষে দীপ্ত’ (ইন্দু সাহা)। ‘ভুলব না কোনোদিন ফাল্গুনের ইতিহাস, ভুলব না খুন রাঙা এই দিন এই মাস’ (সিরাজুল ইসলাম)।
নাজিম সেলিম বুলবুলের ‘নিষ্ফল কভু হয় না রক্তের প্রতিদান’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘মিলিত প্রাণের কলরবে, যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’, শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত ‘কোকিলরে তুই এমন করে ফাগুন মাসে ডাকিস নারে আর,’ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শোন দেশের ভাই ভগিনী শোন আচানক কাহিনী কান্দে বাংলা জননী ঢাকার শহরে’, সত্যেন সেনের ‘আগুন নিভাই বো কেরে, এ আগুন নেভে না নেভে না’। ইন্দুু সাহার লেখা এবং শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুধাল ভোরে’।
নজরুল ইসলাম বাবুর কথা ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন ‘মায়ের শেখানো ভাষা’ এবং রফিকুল আলম গেয়েছেন ‘এক তারাতে সুুর বাইন্দা’। আবদুল লতিফের কথা ও সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘ও আমার এই বাংলা ভাষা’। রুনা লায়লার গাওয়া আরেকটি জনপ্রিয় ভাষা আন্দোলনের গান হলো ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন ‘একুশ তুমি’, শাম্মী আক্তার কণ্ঠ দিয়েছেন ‘বরকত সালামের রক্ত’ গানটিতে। জাহিদুল হকের কথায় ও অজিত রায়ের সুরে শাম্মী আক্তার আরও গেয়েছেন ‘বর্ণমালায় গড়েছি বাংলাদেশ’। কবি আল মাহমুদের কথায় ও খন্দকার নুরুল আলমের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’। জসিম রায়হানের কথায় এবং অজিত রায়ের সুরে সুবীর নন্দী গেয়েছেন ‘বাউল তুমি এমন দেশের কথা বল’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে এন্ড্রু কিশোর গেয়েছেন ‘শহীদ মিনার ভরে গেছে ফুলে ফুলে’। সৈয়দ আবদুল হাদী গেয়েছেন ‘মুখে মধুর বাংলা ভাষা’। আবিদা সুলতানা ও খুরশিদ আলম দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন ‘ক-এর রঙের মতো বাংলা’।
এসব শিল্পীর বাইরে গ্রামগঞ্জের কবিয়াল, স্বভাবকবি, গ্রামীণ বয়াতি ও বাউলসহ বিভিন্ন গায়েনের মনেও ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ স্মৃতি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষার মান রক্ষায় শহীদদের আত্মদানের বিষয়টি নিয়ে কবিগান, জারিগান, গীতিকা রচনা করেছেন। তাদের অনেকের রচনা একুশের গানকে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করেছে। তারা শুধু গান রচনা করেই থেমে থাকেননি, গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে গেয়ে বেড়িয়েছেন। একুশের গান গাওয়ার জন্য তাদের অনেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা নিয়ে লেখা হলেও এ গান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। চারণ কবি আবদুল হাকিম খালি গলায় গাইতেন ‘বাংলা মোদের মাতৃভাষা, বাংলা মোদের বুলি, সেই বাংলায় কথা কইলে পরে বুকে চালায় গুলি’। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের লেখা ‘মিলিত প্রাণের কলরবে’ গানটি শেখ লুৎফর রহমানের সুরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কবিয়াল রমেশ শীলের ‘ভাষার জন্যে জীবন হারালি’।
‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই, এ ভাষাতে মা-কে ডাকি ডেকেছে মোর সালাম ভাই’ (মোহাম্মদ মাতু মিয়া)। ‘ভাষার জন্য জীবন হারালি, বাঙালি ভাইরে রমনার মাটি রক্তে ভাসালি’ (রমেশ শীল)। ‘আমি বাংলা ভালোবাসি, আমি বাংলার বাংলা আমার ওতপ্রোত মেশামেশি’ (রমেশ শীল)। ‘বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারি একুশে ভুলতে পারবে না জীবনে, ভাষা আন্দোলনের জন্য জনসমাজ হলো বিপন্ন কুখ্যাত সরকারের শাসনে’ (কবিয়াল বিজয় সরকার)। ‘কাইন্দ না মা কাইন্দ না আর বঙ্গজননী, তুমি যে বীর প্রসবিনী গো তুমি শহীদ জননী’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস)। ‘বাঙালিদের বাংলা ভাষার রাখি ইজ্জত মান, হাসিমুখে শফিক বরকত করে জীবন দান’ (ফণী বড়–য়া)। ‘এদিক-ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরি, মন দিয়া শোনেন ভাষা আন্দোলনের জারি’ (আবদুল হালিম বয়াতি)। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে, সালাম বরকতের বুকে, গুলি চালায় বেঈমানে (শাহ আবদুল করিম)।’ ‘সালাম আমার শহীদ স্মরণে, দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া, প্রাণ দিলেন যেসব বীর সন্তানে’ (শাহ আবদুল করিম)।
একুশের গানের অন্যান্য কবি ও গীতিকারের মধ্যে রয়েছেন : সত্যেন সেন, জসীমউদ্দীন, আলিমুজ্জামান চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, সিরাজুল ইসলাম, কাজী লতিফা হক, নরেন বিশ্বাস, দিলওয়ার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আবিদ আনোয়ার, বদরু হাসান, জাহিদুল হক, নাসির আহমেদ, মতলুব আলী, শাফাত খৈয়াম, এস এম হেদায়েত, আজাদ রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হুদা, হামিদুল ইসলাম, মুন্সী ওয়াদুদ, তোফাজ্জল হোসেন, হাবীবুর রহমান, আসাদ চৌধুরী, জেব-উন্-নেসা জামাল, মাসুদ করিম, আজিজুর রহমান, কে জি মোস্তফা, আবদুল হাই আল হাদী, নূরুজ্জামান শেখ প্রমুখ। অপরদিকে একুশের গানে সুরারোপ করেছেন মোমিনুল হক, নিজাম উল হক, সমর দাস, সত্য সাহা, আজাদ রহমান, আবদুুল আহাদ, খোন্দকার নূরুল আলম, লোকমান হোসেন ফকির, খান আতাউর রহমান, প্রশান্ত ইন্দু, আবেদ হোসেন খান, দেবু ভট্টাচার্য, বশির আহমেদ, রামগোপাল মোহান্ত, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হরলাল রায়, আলাউদ্দিন আলী, সমর দাস, জাহিদুল হক প্রমুখ।
সময়ের দাবিতে লেখা এসব গানের আবেদন আজও আগের মতোই। বলা যায় সংগ্রামী প্রেরণা সৃষ্টিতে এই সংগীতগুলো বীজ অঙ্কুরিত করে, সৃষ্টি করে আলাদা ব্যঞ্জনা, যা চেতনাকে মোহিত করে। বাস্তবতাকে অতিক্রম করে ভিন্ন একটি মানসিক অবস্থার জন্ম দেয়। তবে শুধু ফেব্রুয়ারিতেই রেডিওতে কিংবা টিভি চ্যানেলে এসব গান শোনা যায়। দেশের অডিও প্রযোজনা সংস্থাগুলোর মাঝেও একুশের গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশের প্রতি একেবারেই উৎসাহ নেই। এভাবে চলতে থাকলে আশঙ্কা জাগে একুশ নিয়ে গানগুলো ধীরে ধীরে কমে যাবে। চেতনার অনেক গানই হারিয়ে যেতে পারে কালের গর্ভে। তাই ভাষা আন্দোলনের গানগুলো সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মহলসহ বিভিন্ন মিডিয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, এমনকি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে গীতিকার, শিল্পী ও সুরকারদের এ তালিকা মোটেও সম্পূর্ণ নয়। বাংলাদেশের গীতিকবিদের প্রায় সবাই একুশের গান করেছেন। তাই লেখায় সবার নাম ও তাদের গানের চরণ উদ্ধৃত করা সম্ভব হয়নি বলে আমরা দুঃখিত।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী