ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থাপনার জোরে কৃষকের রক্ত পানি করা ঘামশ্রমে উৎপাদিত পণ্যই সিন্ডিকেট চক্রের সর্বোচ্চ মুনাফার ক্ষেত্র। করপোরেট শোষণব্যবস্থা একদিকে জমির উর্বরতা শক্তি নিশ্চিহ্ন করছে, অন্যদিকে বৈষম্য-বঞ্চনাজর্জরিত কৃষক শুধু নিঃস্বই হচ্ছে। এসবই সত্যি এবং তা বড়ই হতাশাজনক। বিজয় ও স্বাধীনতার আনন্দ-সুবাতাস কৃষি ও কৃষকসমাজ না পেলে বিশ্ব তালিকায় আজকের রমরমা আর উজ্জ্বল দীপ্তি এক সময় যে নিশ্চিতভাবেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে, আমাদের সে কথা স্মরণে রাখতে হবে

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২ বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী বাংলাদেশ দীর্ঘ এই সময়ে কতটা এগিয়েছে অর্জিত স্বাধীনতাকে জনজীবনে কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, তা নিয়ে নানা সময়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন ও চেতনা বাস্তবায়নে বাঙালি জাতির ব্যর্থতা নিয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবেই হতাশা ও পরিতাপ ফুটে উঠেছে। অনেকেই বুঝেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতসহ যাবতীয় উন্নয়ন সম্ভাবনাকেই হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এতকিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কিছুদিন পরেই বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামক অপমানজনক অভিধায় অভিহিত করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন বলছে, ‘বাংলাদেশের সম্পর্কে অপমানজনক অতীত মূল্যায়ন আসলে নিক্সন সরকারের সবচেয়ে রাজনৈতিক বড় ভুল ছিল।’ কারণ, আয়তনে ছোট এবং অতি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ স্বাধীনতাপরবর্তী ৫২ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই অর্থনীতির প্রায় দুই ডজন অঙ্গনে বিশ্বদরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানসিকতা দিয়ে বিশ্বের ৩৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের ২১টি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক কিছু সুবিধা পেলেও অধিকাংশই বহুকষ্টে অর্জন করে নিয়েছে, যেখানে অমিত সম্ভাবনাময় কৃষি ও কৃষক সমাজই সামনে থেকে দিয়েছে নেতৃত্ব। 
বিশ্বদরবারে এমন সুউচ্চ অবস্থান তৈরি করতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি-সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, মূল মন্ত্রণা ছিল কৃষি ও কৃষকের উদ্যমী, ধৈর্যশীল ও অসম সাহসিকতার মাঝে। কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও খুবই সাধারণ অনেক উদ্যোক্তা প্রচেষ্টা শত বাধা-বিপত্তি নিয়েও অসাধারণ রূপ পেয়েছে। যার হাত ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা বিকশিত হয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে বেসরকারি খাতনির্ভর বিশাল এক অর্থব্যবস্থা। বিকাশ পরিক্রমায় কৃষি খাত সঞ্জীবনী ভূমিকা রাখলেও সব খাতের সম্মিলিত প্রয়াসেই বাংলাদেশের অর্থনীতির আজ আশ্চর্য এক উত্থান ঘটেছে, যা বিশ্ববাসী চোখ বড় করে দেখছে। কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো বড় দেশের পরেই উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চীন-ভারতকেও পেছনে ফেলে বাংলাদেশ প্রথমে অবস্থান নিয়েছে। বড় দাগে অর্থনীতির যে ২১টি খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে তার মধ্যে প্রায় সবই কৃষিখাতের অন্তর্ভুক্ত।

অথচ সামগ্রিকভাবে কৃষিখাতই কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলা-অনাদরের শিকার হয়েছে। কৃষিখাতের এই অবহেলা প্রাপ্তিতে রাষ্ট্রের ইচ্ছা-সদিচ্ছার কিছু দায় থাকলেও যুগের নিয়মে শিল্প ও সেবাখাতের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষও বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনীতির আর্থিক হিসাবে কৃষির অবদান দিন দিন কমে এলেও, এখনো কৃষিই দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা ও মেরুদ-। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির হিস্যা ছিল ১১.২২ শতাংশ (আইএমএফের মতে ১৩.০৭ শতাংশ)। অপরদিকে শিল্প ও সেবাখাতের হিস্যা যথাক্রমে ৩৩.৯২ শতাংশ ও ৫১.০৪ শতাংশ। কিন্তু কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছে মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ শতাংশ।
জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) বলছে, জনসংখ্যা ও আয়তনে বিশ্বে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অনেক দেশ অপেক্ষা বহুগুণ ছোট হলেও প্রাথমিক কৃষিপণ্য (শুধু ফসল) উৎপাদনে ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ এখন ১৪তম অবস্থান নিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য ছিল ৩ হাজার ৬১১ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার সমান। এফএওর মতে, খাদ্যশস্য, ধান, গম, সবজি, মাছ, আলু, আম, পাট, গরু-ছাগল ও মৎস্য উৎপাদনে এখন বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে। নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০-এ।

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ, ইলিশে প্রথম, সবজিতে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম, পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগলের দুধে দ্বিতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়। এ ছাড়াও সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়; চাল, রসুন ও অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত চিনি জাতীয় ফসলে তৃতীয়; জাম, বরই, করমচা, লটকন ইত্যাদি বেরিজাতীয় ফল এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত সুগন্ধি মসলায় চতুর্থ; মসুর ডাল ও গ্রীষ্মম-লীয় ফল কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি উৎপাদনে বাংলাদেশ ষষ্ঠ। সপ্তম অবস্থানে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারিকেলের ছোবড়া উৎপাদনে। চা ও কুমড়ায় বাংলাদেশ অষ্টম। আম, পেয়ারা ও গাবজাতীয় ফল, ফুলকপি ও ব্রকলি এবং মটরশুঁটি ও পাখির খাদ্য (বীজ) শ্রেণিতে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

এফএওর মতে, বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বার্ষিক পৌনে ১ শতাংশ হারে কমলেও এক দশক ধরে কৃষিখাতে গড় প্রবৃদ্ধি ৩.৭ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আবাদি কৃষিজমির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এখনো মোট ভূমির প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষি ও পল্লীর উন্নয়নে ব্যবহার হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত (প্রায় ৫৩ শতাংশ), পাকিস্তান তৃতীয় (প্রায় ৪০ শতাংশ) এবং চতুর্থ থাইল্যান্ড (প্রায় ৩৩ শতাংশ)।
বিশ্ব কৃষির বহুবিধ অঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্যে বাঙালি হিসেবে খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে ঠিকই, কিন্তু আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। বরং কিছুটা মনোবেদনা প্রকাশ করা যায়। কারণ, বাংলাদেশ গঠনের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের কাজে কৃষিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আর্থিক বছরের বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দের মধ্যে ১০১ কোটি টাকাই রাখা হয়েছিল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে। ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের খাদ্যের মোট চাহিদা ছিল প্রায় ৪৫ লাখ টন। খাদ্য মজুদ ছিল মাত্র ৪ লাখ টন।

এ অবস্থায় কৃষিতে বিপ্লব না হলে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে যাবে, বঙ্গবন্ধু তা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই ‘কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ এই ধারণাকে তিনি হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন এবং সেই আলোকেই কৃষিখাতকে ঢেলে সাজানোর কর্মপরিকল্পরা হাতে নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সমাবর্তন উৎসবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় নাÑ বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাক-সবজি এসবকে বোঝায়।’ ওই সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াদের মতো কৃষিবিদদেরও চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে সার্বিকভাবে পুনর্বাসন করেছিলেন। স্বল্প ও বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে কৃষককে নতুন করে কর্মোদ্যোগী করে তুলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, পাকিস্তান সরকারের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা বাতিল, পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত সিলিং নির্ধারণ, কম দামে ৪০ হাজার লো-লিফট পাওয়ার পাম্প, প্রায় ২৯ হাজার গভীর ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন, উচ্চফলনশীল ধান-পাট-গমবীজ-সার ও কীটনাশকসহ কিছু কৃষি অনুষঙ্গ বিনামূল্যে সরবরাহের পাশাপাশি কৃষিঋণ বিতরণ, হালের বলদ ও গাভী বিতরণ করে খুব অল্প সময়েই কৃষিখাতকে নতুন দিশা দিয়েছিলেন।

কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, উৎপাদিত পণ্য গুদামজাত করার জন্য খাদ্যগুদাম নির্মাণ ইত্যাদি বহুমুখী প্রণোদনার ফলে ১৯৭৪-৭৫ সালে আবাদি জমির পরিমাণ মুক্তিযুদ্ধের (১৯৬৮-৬৯) আগের বছরগুলোর তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৭৪ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও পশ্চিমা দেশগুলোর খাদ্যশস্যে ভর্তি জাহাজ আসতে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালে কৃষিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার পৌঁছেছিল ৭ শতাংশে। ১৯৭০-এর দশকে চাল উৎপাদন যেখানে মোটামুটি ছিল ১২ মিলিয়ন টন পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ মিলিয়ন টন হয়েছে, যার মূলে ছিল গভীর নলকূপ ও ভূ-উপরিস্থ সেচব্যবস্থার প্রবর্তন।

এসবের হাত ধরেই সত্তরের দশকে যেখানে দুই মিলিয়ন টনের বেশি বোরো উৎপাদন হতো না, সেখানে ২০০০ সালের দিকে তা ৪ গুণ বেড়ে ৮ মিলিয়ন টন হয়েছে এবং আমনকে ছাড়িয়ে গেছে। গত দুই দশকে কৃষিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বোরো উৎপাদন ২০ মিলিয়ন টনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমন উৎপাদন বেড়েছে ৭-৮ থেকে ১৩-১৪ মিলিয়ন টন হয়েছে। তারপরও পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কৃষি তার অগ্রগতির গতি ও প্রবণতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। 
বাংলাদেশ বিগত পাঁচ দশকে চাল উৎপাদন সমস্যার সমাধান করলেও অন্য ফসলের ক্ষেত্রে কিছুটা মিশ্র সাফল্য দেখিয়েছে। যেমনÑ আগে গম উৎপাদন ছিল প্রায় ২ মিলিয়ন টন, যা ২০০৬-০৭ সালের দিকে হ্রাস পেয়ে হয় ৭ লাখ টন এবং পরে তা ধীরে কিছুটা বেড়ে ১০-১১ টন হয়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য গমের উৎপাদন তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়ে আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। অথচ আধুনিক খাদ্য অভ্যাসের কারণে গমের ব্যবহারও প্রাকৃতিক নিয়মে অনেক বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব গম বাজারে অস্থিতিশীলতায় দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে আটার মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে চালের মূল্যকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং আটার স্বল্পতা চালের মূল্য বৃদ্ধিতে অনুঘটক ভূমিকা পালন করেছে।

বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ে কৃষির যূথবদ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনার দর্শন থেকে অনেকটা দূরে সরে না গেলে গমে আমাদের এ অবস্থা হতো না। এ রকম ঘটেছে কৃষির আরও কিছু ক্ষেত্রে। অথচ কৃষির ঈর্ষণীয় সাফল্যই বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এক সময়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে নিরাপদ স্তরের দুর্যোগকালীন মজুত রেখেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত পণ্য। বিগত এক দশকে কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরন্তর উদ্ভাবনী প্রয়াস বাংলাদেশের এই অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। 
কৃষিপণ্যের অনেক অঙ্গনে বিশ্বে শীর্ষে থাকলেও কৃষির সবকিছুই যে আলোয় উদ্ভাসিত, তেমনটা কিন্তু না। প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, বাংলাদেশর কৃষির গভীরের অনেক কিছুই তেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর প্রমাণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিগতভাবে কৃষি ও কৃষকই সর্বাধিক বৈষম্যের শিকার প্রবণতা। কৃষকের বঞ্চনা-বৈষম্যের প্রবৃদ্ধি যেন প্রকৃতিপ্রদত্তভাবে নিরন্তর ঊর্ধ্বপানে ধাবমান। ভূমি ও ভূমি আইনে কৃষকই সবচেয়ে বড় বঞ্চিতজন। অথচ পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থাপনার জোরে কৃষকের রক্ত পানি করা ঘামশ্রমে উৎপাদিত পণ্যই সিন্ডিকেট চক্রের সর্বোচ্চ মুনাফার ক্ষেত্র। করপোরেট শোষণব্যবস্থা একদিকে জমির উর্বরতা শক্তি নিশ্চিহ্ন করছে, অন্যদিকে বৈষম্য-বঞ্চনাজর্জরিত কৃষক শুধু নিঃস্বই হচ্ছে। এসবই সত্যি এবং তা বড়ই হতাশাজনক। বিজয় ও স্বাধীনতার আনন্দ-সুবাতাস কৃষি ও কৃষকসমাজ না পেলে বিশ্ব তালিকায় আজকের রমরমা আর উজ্জ্বল দীপ্তি এক সময় যে নিশ্চিতভাবেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে, আমাদের সে কথা স্মরণে রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×