ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ’৭২-এর সংবিধান

ওয়ালিউর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৩ নভেম্বর ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ’৭২-এর সংবিধান

.

সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। একটা দেশ কিভাবে চলবে, নাগরিকদের অধিকার কী থাকবে, সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক, শাসন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক নীতি ইত্যাদির দলিল হচ্ছে এই সংবিধান। আধুনিক বিশ্বে সংবিধান ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তা সে লিখিত বা অলিখিত যাই হোক না কেন। রাষ্ট্রকে জানা যায় সংবিধান দ্বারা। সংবিধান না থাকলে একটি রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সংবিধান সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এমন এক জীবন পদ্ধতি, যা রাষ্ট্র স্বয়ং নিজের জন্য বেছে নেয়।

১৯৪৭- দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাংবিধানিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লাগাতার রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখ-

বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশ, লাল-সবুজ পতাকা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরের দিন ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধানের আদেশ জারি করেন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেন যে, বাঙালি জাতি যুগে যুগে নিপীড়িত মানবাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত হয়েছে শোষিত-নিষ্পেষিত, যে বাঙালির দল আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও ক্ষমতা পাবার পরিবর্তে শিকার হয়েছে পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যার, তার মানবাধিকার সমুন্নত হওয়া এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন।

গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। গণপরিষদের প্রথম স্পিকার ছিলেন শাহ আবদুল হামিদ এবং ডেপুটি স্পিকার ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। গণপরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে ৩৪ জন নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন . কামাল হোসেন। সংবিধান কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম রাজিয়া বানু।

১৭ এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মতামত আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ভারত ইংল্যান্ডের সংবিধানের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সংবিধান কমিটি একটি খসড়া তৈরি করে। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী . কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। নভেম্বরকে বাংলাদেশের সংবিধান দিবস বলা হয়।

গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।

৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। বঙ্গবন্ধু ধরনের সংবিধানের গুরুত্ব অনুভব করেছেন স্বাধীনতা-পূর্ব তাঁর সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবনে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে শোষণ বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোনার বাংলা উপহার দেওয়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল দর্শন। 

বছর  বাংলাদেশের সংবিধানের ৫২ বছর পূর্ণ হচ্ছে।  এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে দেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। 

জেনারেল জিয়া পঞ্চম সংশোধনী এবং জেনারেল এরশাদ সংবিধানে সপ্তম অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির মৌলিক পরিবর্তন করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন।

জাতির পিতাকে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল, তার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। আর ওই সময় খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের ঘাতক দল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল যাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা না যায়। এটাকে তখন সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম একটি মৌলিক বিষয় ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমানের সরকার সেখানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেইবিসমিল্লহির রাহমানির রাহিমযুক্ত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনের সব কর্মকান্ডকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় পর ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে এই পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা পায় এরশাদের সামরিক শাসন। তিনি ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসন বহাল রেখেছিলেন। সে সময়ের সব কর্মকা-ের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার এই সপ্তম সংশোধনীকেও উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে।

অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সংবিধানে এই অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছিল। এই আন্দোলনে আরও যোগ দিয়েছিল বামপন্থি এবং বিএনপির কিছু লোক।

জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদ সংবিধানের মূল চরিত্র চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন, কিন্তু তাদের সেই মিথ্যার দাপট দেশের জনগণের সামনে বেশিদিন টিকতে পারেনি।

কতিপয় শর্তসাপেক্ষে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের কারণে প্রয়োজনে সংবিধানে সংযোজন-বিয়োজন-পরিবর্তন করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা জনগণের স্বার্থের বাইরে গিয়ে করা উচিত নয়। তাহলে সংবিধানের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে না। কারণ জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানকে সম্মান করা এবং সাংবিধানিক বিধি-বিধান মেনে চলা।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের দুই বছর পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয় ফিরিয়ে আনা হয়। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার শাসনকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রধর্ম অংশে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা সমঅধিকার নিশ্চিত করিবে।

অপরদিকে দ্বিতীয়ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় স্বাধীনতা অংশে লেখা আছে- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য- () সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, () রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, () রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, () কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন,- বিলোপ করা হইবে।

রাষ্ট্রের এই চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই সচেতন ছিলেন। ১৯৭২ সালের অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। ...ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে যে নির্যাতন পাকসেনারা করেছিল সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সাংবিধানিক কাঠামোয় উপস্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন তা সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করে। সমাজতন্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেছেন- ‘সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ।

পাকিস্তান দীর্ঘ নয় বছরেও সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি। সেখানে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার জাতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান দিয়েছিল, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এত অল্প সময়ের মধ্যে নিখুঁত সংবিধান প্রণয়ন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এটি ছিল সমসাময়িককালের অন্যান্য দেশের সংবিধানের চেয়ে উন্নত  এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। বঙ্গবন্ধু মানবাধিকার, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার সমন্বয়ে যুগোপযোগী প্রয়োজনীয় সংবিধান দিতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজকে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেলে উপনীত করেছেন।

প্রতিবছর নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তেমনভাবে পালন করতে দেখা যায় না। অনেক দেশে সব স্তরের শিক্ষায় বিভিন্ন মাত্রায় সংবিধানকে জানার সুযোগ রাখা হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তেমনটি করা উচিত, যাতে তরুণরা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি রাষ্ট্র গঠন, পরিচালনা রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চেতনা জাগ্রত রাখতে অনাগত প্রজন্মের কাছে সংবিধান লালন বিকাশে দিনটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা উচিত।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সচিব

×