ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

মহানবীর (সা.) প্রিয় সাহাবী আদি বিন হাতেম (রা.)

মনিরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৩

মহানবীর (সা.) প্রিয় সাহাবী আদি বিন হাতেম (রা.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

হাতেম তাই ও আদি বিন হাতেম ইতিহাসের দুটি বিখ্যাত নাম। প্রথমজন দানশীলতার জন্য কিংবদন্তি আর দ্বিতীয়জন তারই সন্তান- মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রিয় সাহাবী। তাদের বংশ অতি উঁচু মার্গের। খ্যাতির দিক থেকে কারও চেয়ে কেউ কম নন।
হাতেম তাই ছিলেন তায়ী গোত্রের রাজা। আর তায়ী গোত্র ছিল খ্রিস্টান গোত্র। হাতেম তাই মারা যাওয়ার পর আদি বিন হাতেমই হন তায়ী গোত্রের রাজা। সেই সময় আরবের চারদিকে ইসলামের বিজয় নিশান উড়তে শুরু করেছে। তখন আদি বিন হাতেম ভাবলেন, রাসূল (সা.) হয়তো তার রাজত্ব কেড়ে নিতে পারেন। তাই তিনি তার পরিবার এবং গোত্রসহ সিরিয়াতে চলে যাচ্ছিলেন। যেখানে আদি ইবনে হাতেমদের ধর্মানুসারীরা বসবাস করে। তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার কারণে পথিমধ্যে আদি ইবনে হাতেমের ছোট বোন এবং গোত্রের কয়েকজন হাত ছাড়া হয়ে পড়েন, যারা পরবর্তীতে মুসলিমদের হাতে বন্দি হন।

আদি ইবনে হাতেমের বোন মুসলিমদের হাতে বন্দি হওয়ার পর, রাসূলকে (সা.) বলেন আমি একজন অসহায় নারী।আপনি আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন এবং আমাকে সিরিয়া পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। রাসূল (সা.) কয়েকটি উট যাত্রার জন্য সজ্জিত করলেন এবং তাকে সিরিয়া পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
আদি বিন হাতেম তার বোনকে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। তখন আদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, রাসূলের (সা.) সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি মক্কার পথে রওনা হয়ে গেলেন। আদি মসজিদে ঢুকে রাসূলকে (সা.) সালাম দিলেন। রাসূল (সা.) তার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং সঙ্গে করে নিজের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে, এক অসহায় মা রাসূলের (সা.) সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে থেকে সেই মায়ের সমস্ত কথা শুনলেন। এই চিত্র দেখে আদি বিন হাতেম ভাবলেন, এটা কোনো রাজা কিংবা বাদশাহের ব্যবহার হতে পারে না। রাসূল (সা.) আদি বিন হাতেমকে বললেন, তুমি মিরবা নামক জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় এমন কিছু দ্রব্য গ্রহণ করেছ যা তোমার ধর্মে নিষিদ্ধ। এই কথা শুনে আদি নিশ্চিত হয়ে যান যে, ইনিই আল্লাহর রাসূল।
রাসূল (সা.) আদিকে বলেন, তুমি সম্ভবত ইসলাম গ্রহণ করছ না তিনটি কারণে। প্রথম কারণ, মুসলমানদের অভাব ও দারিদ্র্য দেখে। আল্লাহর শপথ অচিরেই মুসলিমদের সম্পদ এত বেশি হবে যে জাকাত গ্রহণ করার মানুষ থাকবে না। হজরতের এ কথা সত্যি প্রমাণিত হয় উমরের (রা.) খেলাফতকালীন সময়ে। দ্বিতীয় কারণ, তুমি সম্ভবত ইসলাম গ্রহণ করছ না মুসলিমদের সংখ্যা কম দেখে এবং তাদের শত্রু বেশি দেখে। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর শপথ। খুব শীঘ্রই এমন হবে যে, সুদূর কাদেসীয়া থেকে নারী আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে আসবে।

কিন্তু লোকবল ও নিরাপত্তা এত মজবুত হবে যে, একজন নারী পর্যন্ত বিন্দুমাত্র ভীতি অনুভব করবে না। তৃতীয় কারণ, সম্ভবত অমুসলিমদের হাতে রাজত্ব দেখে তুমি ইসলাম গ্রহণ করছ না। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর শপথ ! খুব শীঘ্রই বাবেলের শুভ্র ভবনটি মুসলিমরা বিজয় করবে এবং হরমুজের ধন ভা-ার মুসলিমদের করতলে চলে আসবে। (অবশ্য পরবর্তীতে হয়েছেও তাই)।  
তখন আদি রাসূলের (সা.) হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। দানবীর হাতেম তাইয়ের পুত্র আদি বিন হাতেম (রা.) হয়ে যান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের সাহাবী। আর রাসূলের (সা.) বর্ণিত ভবিষ্যৎ বাণীর সবই আদি বিন হাতেম (রা.) নিজ চোখে অবলোকন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
হযরত আদি বিন হাতেম বর্ণিত কিছু হাদিস : হাফস ইবনু উমর (র.) .... আদি ইবনু হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর সম্পর্কে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, তুমি যখন তোমার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর শিকার করতে ছেড়ে দাও, তখন সে হত্যা করলে তা তুমি খেতে পার। আর সে তার কিছু অংশ খেয়ে ফেললে তুমি তা খাবে না। কারণ, সে তা নিজের জন্যই ধরেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কখনো কখনো আমি আমার কুকুর (শিকারে) পাঠাই, এরপর তার সঙ্গে অন্য এক কুকুরও দেখতে পাই (এমতাবস্থায় শিকারকৃত প্রাণীর কি হুকুম)? বললেন, তাহলে খেও না। কারণ, তুমি বিসমিল্লাহ বলেছ কেবল তোমার কুকুরের বেলায়, অন্য কুকুরের বেলায় বিসমিল্লাহ বলনি। সহীহ বুখারী-১৭৫ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। 
সহীহ বুখারী, পরিচ্ছেদ ঃ ৮৯০. আল্লাহর বাণী : যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ও নিজেদের আত্মার দৃঢ়তার জন্য ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা কোনো উচ্চভূমিতে অবস্থিত একটি উদ্যান এবং যাতে সর্বপ্রকার ফলমূল আছে। (২:২৬৫-৬৬) ।
সহীহ বুখারী, পরিচ্ছেদ ২০৭৫. ইসলাম আগমনের পর নবুয়তের নিদর্শনসমূহ : মুহাম্মদ ইবনুল হাকাম (র.)... আদি ইবনু হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবীর (সা.) মজলিসে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে দুর্ভিক্ষের অভিযোগ করল। তারপর আর এক ব্যক্তি এসে ডাকাতের উৎপাতের কথা বলে অনুযোগ করল। নবী (সা.) বললেন, হে আদি, তুমি কি হীরা নামক স্থানটি দেখেছ? আমি বললাম, দেখি নাই, তবে স্থানটি আমার জানা আছে। তিনি বললেন, তুমি যদি দীর্ঘজীবী হও তবে দেখতে পাবে একজন উট সওয়ার হাওদানশীন মহিলা হীরা থেকে রওনা হয়ে বায়তুল্লাহ শরীফে তাওয়াফ করে যাবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করবেন না। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম তাঈ গোত্রের ডাকাতগুলো কোথায় থাকবে, যারা ফিতনা ফাসাদের আগুন জ্বালিয়ে দেশকে ছারখার করে দিচ্ছে।
তিনি বললেন, তুমি যদি দীর্ঘজীবী হও, তবে নিশ্চয়ই দেখতে পাবে যে, (পারস্য স¤্র্রাট) কিসরার ধনভাণ্ডার কবজা করা হয়েছে। আমি বললাম, কিসরা ইবনু হুরমুযের? নবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ, কিসরা ইবনু হুরমুযের। তোমার আয়ু যদি দীর্ঘ হয়, তবে অবশ্যই তুমি দেখতে পাবে, লোকজন মুষ্টিভরা জাকাতের স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে বের হবে এবং এমন ব্যক্তিকে তালাশ করে বেড়াবে যে, তাদের এ মাল গ্রহণ করে। কিন্তু গ্রহণকারী একটি মানুষও পাবে না। তোমাদের প্রত্যেকটি মানুষ কিয়ামত দিবসে মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে। তখন তার ও আল্লাহর মাঝে অন্য কোনো দোভাষী থাকবে না যিনি ভাষান্তর করে বলবেন।
আল্লাহ্ বলবেন, আমি কি (দুনিয়াতে) তোমার নিকট আমার বাণী পৌঁছানোর জন্য রাসূল প্রেরণ করিনি? সে বলবে, হ্যাঁ। প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাকে ধন-সম্পদ, সন্তানসন্ততি দান করিনি এবং দয়া মেহেরবাণী করিনি? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, দিয়েছেন। তারপর সে ডান দিকে নজর করবে, জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না। আবার সে বামদিকে নজর করবে, তখনো সে জাহান্নাম ব্যতীত কিছুই দেখবে না। আদি (রা.) বলেন, আমি নবীকে (সা.) বলতে শুনেছি, অর্ধেকটি খেজুর দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর আর যদি তাও করার তৌফিক না হয়, তবে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক সৎ ও ভালো কথা বলে নিজেকে আগুন থেকে রক্ষা কর।
আদি (রা.) বলেন, আমি নিজে দেখেছি, এক উট সওয়ার মহিলা হীরা থেকে একাকী রওনা হয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করেছে। সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না। আর পারস্য সম্রাট কিসরা ইবনু হুরমুযের ধনভাণ্ডার যারা দখল করেছিল, তাদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম...। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×