ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

উলিপুরে স্থান সংকটে নষ্ট হচ্ছে ভাওয়াইয়া একাডেমী ও জাদুঘরের দুর্লভ ঐতিহ্য ও উপকরণ

জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ১৬ জুন ২০২৫; আপডেট: ১১:৫৫, ১৬ জুন ২০২৫

উলিপুরে স্থান সংকটে নষ্ট হচ্ছে ভাওয়াইয়া একাডেমী ও জাদুঘরের দুর্লভ ঐতিহ্য ও উপকরণ

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্রান্তিক এক কোণে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে ‘ভাওয়াইয়া একাডেমী’। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের পরিক্রমায় এটি এখন রূপ নিয়েছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক স্থাপনায় ‘ভাওয়াইয়া জাদুঘর-এ। এই জাদুঘরের নামকরণ করা হয়েছে ‘কছিম উদ্দিন লোকশিল্প জাদুঘর’ কুড়িগ্রামের প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পীর নামে। যিনি এই গানের সুর বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন।

জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে দুর্গাপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলেপ উদ্দিন সরকারের দানকৃত পাঁচ শতক জমির মাধ্যমে। এরপর টিনশেডের একটি ভবন নির্মাণ করা হয় স্থানীয় ও কিছু সরকারি সহায়তায়। এখানেই চালু হয় ‘ভাওয়াইয়া একাডেমী’। এখানে বিনামূল্যে পাঁচটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়- ভাওয়াইয়া গান, দোতারা, সারিন্দা, ঢোল ও বাঁশি। ভূপতিসহ আটজন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক এই সেবায় নিয়োজিত। প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিকেলে ক্লাস হয়। বর্তমানে ৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত অংশ নিচ্ছে, আর এই একাডেমী থেকে ইতোমধ্যে উপকৃত হয়েছেন দুই হাজার পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী।

জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত হয়েছে গ্রামীণ বাংলার প্রায় দুই হাজার বিলুপ্তপ্রায় বা বিলুপ্তির মুখে থাকা লোকজ উপকরণ। যেগুলো এক সময় ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে স্থান সংকটের কারণে অনেক মূল্যবান উপকরণ অগোছালোভাবে বারান্দায় পড়ে আছে। অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবুও দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন এসব দুর্লভ ঐতিহ্য একনজর দেখতে। জাদুঘরে স্থান পেয়েছে একশ’রও বেশি দুষ্প্রাপ্য উপকরণ। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কাঠের যুঁত, লাঙ্গল, কুরসি, গরু চালানোর পেন্টি লাঠি, করাইল কুড়াল, বাকুয়া (কাঁধে বহনের বাঁশি দণ্ড), চাষির বাঁশের টুপি ‘টোপা’, ধান ঝাড়ার কুলা-ঝাঁপি, ভার বহনের পেঁষ্টা। এছাড়াও আছে ধান প্রসেস করার ‘উরুণ-গাইন’ ও ‘পাট’। মাছ ধরার পুরনো দিনের বার্ষি, ডারকি, দেরু, পালো, চাক, মাছ রাখার খলাই ও জিনা। এসবই যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের জীবন্ত দলিল। আছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, সারিন্দা, ঢোল, বাঁশি, দোতারা এবং খড়ম সবকিছুই যা ভাওয়াইয়া গানে এসেছে উত্তরবঙ্গীয় নামেই। এ বিশাল সংগ্রহের নেপথ্য নায়ক একজন ভূপতি ভূষণ বর্মা। উলিপুরের দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক একজন খ্যাতিমান ভাওয়াইয়া শিল্পী ও গবেষক। ১৯৯৩ সাল থেকে একক প্রচেষ্টায় তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন গ্রামীণ বাংলার হারিয়ে যাওয়া অতীত। দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন মঞ্চে ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন উত্তর বাংলার সুর বিশ্বের দরজায়।

ভূপতি ভূষণ বর্মা মনে করেন, আধুনিক প্রজন্মকে শিকড়ে ফেরাতে হবে গান ও ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন ঘটিয়ে। এসব উপকরণ কেবল সংগ্রহ নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। আমরা চাই, মানুষ গান শুনুক, কিন্তু তার সঙ্গে দেখে-জানুক কী ছিল এই গানের পেছনের বাস্তবতা। ভাওয়াইয়া জাদুঘরের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কছিম উদ্দিনের জন্য কিছুই করতে পারিনি। অথচ তিনি এই গানকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি। তার স্মরণেই আমরা এই জাদুঘরকে তার নামে উৎসর্গ করেছি। এটাই আমাদের পক্ষ থেকে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে সব অর্জনের মাঝেও বড় প্রতিবন্ধকতা স্থান সংকট। ভূপতি আক্ষেপ করে বলেন, জাদুঘরের সংগ্রহগুলো আমরা একটি কক্ষে ও বারান্দায় রেখেছি। অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের একটি বহুতল ভবন প্রয়োজন। কিন্তু নিজস্ব কোনো আর্থিক সামর্থ্য নেই।

ভাওয়াইয়া শিল্পীরা জানান, কালের বিবর্তনে যেসব ধ্বংস হতে বসেছে, এই জাদুঘর যেন তা সংরক্ষণের এক নিবেদিত মঞ্চ। যদি স্থান সংকট দূর হয়, তবে এটি উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাস সংরক্ষণের একটি অনন্য নিদর্শনে পরিণত হবে।

ভাওয়াইয়া একাডেমী ও জাদুঘরের উপদেষ্টা লেখক-গবেষক আবু হেনা মুস্তফা জানান, সরকারিভাবে যে অনুদান পাওয়া যায়, তা দিয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। ব্যক্তিগত দাতারাই মূলতঃ প্রাত্যহিক ব্যয় পরিচালনা করে। একটি বহুতল ভবন নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। একাডেমীতে প্রদর্শিত লোক ঐতিহ্যের অমূল্য  নিদর্শনগুলো সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ, ভাওয়াইয়া সংগীতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটি বহুতল ভবনের খুব প্রয়োজন। যেখানে থাকবে সংগীতের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণাগার, সেমিনার কক্ষ।  এ বিষয়টিতে সু-নজর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছেন তিনি।

নোভা

×