ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

লন্ডনের চিঠি

প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা

তবে কি টেক্সট লিখে অ্যাপগুলোকে ছবি আঁকার নির্দেশনা দিতে পারলেই যে কেউ শিল্পী হিসেবে গণ্য হবেন

তবে কি টেক্সট লিখে অ্যাপগুলোকে ছবি আঁকার নির্দেশনা দিতে পারলেই যে কেউ শিল্পী হিসেবে গণ্য হবেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হবেন। ভবিষ্যতের শিল্পীদের হয়ত আর চারুকলা বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানে ছবি আঁকা শিখতে যেতে হবে না, যেতে হবে তুলি-কালি-ক্যানভাসহীন কম্পিউটার শেখার ক্লাসে!

ঐ ফটোটি দেখেছেন? ছিয়াশি বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিস একটি ধবধবে সাদা পাফার জ্যাকেট পরে রোমের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফোলা বড়সড় জ্যাকেটের সঙ্গে তার ঋজু হাঁটার ভঙ্গি, হাতে কোনো একটা কফি বা পানিয়ের মগ ধরে রাখা, মুখের উপরে পড়া রোদ ঝলমল করছে, জ্যাকেটের উপরে ঝোলানো ক্রুশÑ সব মিলিয়ে বেশ চমকপ্রদ ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। পোপের এই অত্যাধুনিক পোশাক পরা ছবিতে লাইক, কমেন্ট শেয়ারের বন্যা বয়ে যায়। একটাই সমস্যা। ছবিটি ফেইক। পোপ ফ্রান্সিস অমন কোনো পোশাকে জীবনেও অমন পোজ দেননি।

এ বয়সে এসে তার পক্ষে অমন ঋজু ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভঙ্গিতে হাঁটাও অসম্ভব। অথচ ছবিটি দেখে অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করে বসে যে, সত্যিই এটি পোপ ফ্রান্সিসের আসল ছবি। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাদা চোখে ছবিটিতে কোনো জোচ্চুরি আছে বলে ধরা প্রায় অসম্ভব। এই ছবিটি কোনো মানুষ তৈরি করেনি, করেছে মিডজার্নি নামক একটি ছবি আঁকার প্রোগ্রাম।
চ্যাট জিপিটি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মিডজার্নিও তাই। চ্যাট জিপিটি কাজ করে টেক্সট নিয়ে, মিডজার্নির কাজ আঁকাআঁকি নিয়ে। যে ভদ্রলোক পোপের ঐ ছবিটি এঁকেছে (কিংবা বলা ভালো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে আঁকিয়েছেন), তার নাম পাবলো জাভিয়ার। একত্রিশ বছর বয়সী জাভিয়ার মূলত একজন নির্মাণকর্মী। বাড়ি শিকাগো। অবসর সময়ে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করা তার বিনোদনের অংশ। ছবিটি তৈরি করতে তার সময় লেগেছে বড় জোর ত্রিশ সেকেন্ড।

মিডজার্নি ওয়েবসাইটে ঢুকে তাকে শুধু লিখতে হয়েছে : The pope in Balenciaga puffy coat, Moncier, walking the streets of Rome, Paris. কথাটি মিডজার্নির চ্যাট বক্সে লিখে কফিতে এক চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগেই ছবি তৈরি। এই একই ছবি যদি আপনি ফটোশপ বা এ জাতীয় কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে ম্যানুয়ালি করতে যেতেন, তবে আপনাকে ফটো সম্পাদনার কাজে অতি দক্ষ একজন তো হতে হতোই, কাজটাতে সময় লাগতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মিডজার্নিতে অ্যাকাউন্ট করে যে কেউই যে কোনো ধরনের ছবির ‘আব্দার’ লিখে দিলে মুহূর্তেই অ্যাপটি এত সুন্দর সুন্দর সব ছবি এঁকে দেবে, যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে মাত্র কয়েকটা শব্দ লিখেই এই ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
পোপের ছবিটি ভাইরাল হতে না হতেই চারদিকে হৈ হৈ রব উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা ও সম্পাদনা করা ছবির বিপদাপদ নিয়ে নতুন করে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে নেট কমিউনিটি। মিডজার্নি এতদিন যে কাউকেই ফ্রি অ্যাকাউন্টে ছবি আঁকার কিছু সুবিধা দিত। পোপের ছবির ইস্যুতে সুবিধাটির অপব্যবহারের কথা সামনে এনে তারা ফ্রি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। মিডজার্নিতে এখন কেবল নির্দিষ্ট সাবস্ক্রিপশনের বিনিময়ে ছবি আঁকার কাজ করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর চাউর হতে না হতেই মিডজার্নির আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় একদল পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের মাঝখানে পুলিশদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন। এখানেও সেই একই ব্যাপার। বলে না দিলে, এটি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে, চ্যাট বক্সে স্রেফ কয়েকটা শব্দ লিখে সম্পাদনা করা ছবি, তা সাধারণ মানুষের বোঝা প্রায় অসাধ্য! এরকম অসংখ্য ছবি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে নেট দুনিয়ায়। পাবলো জাভিয়ারের মতো বেশিরভাগ মানুষই মূলত মজা করার জন্য এ ধরনের ছবি তৈরি করছেন বটে।

কিন্তু তার প্রভাব যে কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা যদি একটুখানি ভাবা যায়, তবে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সমস্যাটা কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা ছবি নিয়ে নয়, মূল সমস্যা এ ধরনের একটি ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া এবং কোনো রকম কোনো প্রশ্ন না তুলে তাকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করা নিয়ে। 
আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা খুব দ্রুত বদলাচ্ছে বেশ কয়েক দশক ধরেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিও খুব একটা পুরনো নয়। কিন্তু তার ব্যবহার যেই সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় ঢুকে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে যেন বদলানোর পালে জোর হাওয়া লেগেছে। আমার বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচরণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনবোধÑ সবকিছুতেই হু হু করে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এই প্রযুক্তি। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, এই পরিবর্তনটার জন্য পৃথিবীর কোনো দেশই তৈরি নয়।

সত্য এবং মিথ্যার, প্রকৃত এবং ভেজালের পর্দা সূক্ষ্ম হতে হতে প্রায় না দেখতে পাওয়ার সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। একসময় মানুষ মুখের কথাকে বিশ্বাস করতে না পারলে লিখিত প্রমাণ চাইতো। সেটা যেহেতু খুব সহজেই জাল করা যায়, তার পরে চাওয়া শুরু হলো ফটোগ্রাফিক সত্যতার। সেই কালের অবসানও হয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়। মিডজার্নি, ডালি-২, স্ট্যাবল ডিফিউশন কিংবা এডোবির ফায়ার-ফ্লাই নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ছবি আঁকা কিংবা সম্পাদনার কাজ করতে পারার অ্যাপগুলো এখনো অনেকটাই বেটা পর্যায়ে আছে।

পৃথিবীজুড়ে মিলিয়ন ব্যবহারকারী প্রতিদিন সেগুলোতে কাজ করে প্রতিদিনই এই অ্যাপগুলোর শক্তিমত্তা বাড়িয়ে তুলছে প্রচ-গতিতে। সন্দেহ নেই, অচিরেই এদের পুরো ক্ষমতা উন্মোচিত হবে। চ্যাট জিপিটি কিংবা এই ছবি আঁকার অ্যাপগুলো আমাদের জানা পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে বা দেবে এমনভাবে, যার জন্য খুব সম্ভবত আমরা আর প্রস্তুত হওয়ার সময় পাব না। এই যে, চাইলেই যে কেউই ফ্রি অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছে, তা যতটা ফ্রি বলে ভাবছি ততটা নয় আসলে। আপনি, আমি এবং পৃথিবীজুড়ে আমাদের মতো মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যবহারকারী প্রতিদিন ঐ অ্যাপগুলো ব্যবহার করে ওদের লার্নিং-প্রসেসটিকে ত্বরান্বিত করছি।

আমাদের ইনপুট করা প্রতিটি শব্দ, নির্দেশনা, বাক্য এই অ্যাপগুলোকে ‘শিক্ষিত’ করে তুলছে যাতে ওরা আরও নিখুঁত হয়ে উঠতে পারে। মেশিনটির ব্রেইন তৈরি করেছে হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে তাকে উন্নত করার কাজ, জেনে কিংবা না জেনে করছি পৃথিবীর আমরা সবাই মিলে।
যে কোনো নতুন প্রযুক্তিই কিছু সুবিধার সঙ্গে কিছু অসুবিধা নিয়ে আসে। বিষয়টা নির্ভর করে প্রযুক্তিটিকে কিভাবে ব্যবহার করা হবে, তার গতিবিধিকে কতটা মানুষের কল্যাণের সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবেÑ তার ওপর। ইউরোপের দুয়েকটা দেশে ইতোমধ্যে চ্যাট জিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাপগুলোর ব্যবহার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে।

অচিরেই হয়তো এ কাতারে অনেক দেশ যোগ দেবে। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পরীক্ষা-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছে। কোথাও কোথাও খুব সীমিত পর্যায়ে চ্যাট জিপিটিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে তাদের ছাত্রছাত্রীদের। মোদ্দাকথা, এই গ্রহণ-বর্জন-শঙ্কা-সম্ভাবনার কাল চলবে আগামী বেশ কিছুদিন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, চ্যাট জিপিটি কিংবা মিডজার্নির মতো অ্যাপগুলোর যে শক্তি, তাকে খুব সাবধানতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যে দেশ ব্যবহার করতে পারবে, তারাই চড়ে বসবে আগামী প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীর চালকের আসনে।

ভুলে যাবার কোনো উপায় কি আছে, বর্তমানের এই ‘ভাইরাল’ যুগে, যেখানে প্রায় প্রতিটি মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের অবাধ স্বাধীনতা, তাতে ‘শয়তানি’ উদ্দেশ্যে তৈরি করা একটা জাল ছবি কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কী তুলকালাম কা- ঘটিয়ে ফেলতে পারে! আজকের দুনিয়ার জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এ আই প্রযুক্তিকে। দ্য টপ রিস্ট রিপোর্ট ২০২৩ এই প্রযুক্তিকে চিহ্নিত করেছে  ‘’ হিসেবে। তাদের ভাষায়, ’they will erode social trust, empower demagogues and authoritarians, and disrupt businesses and markets.’

এ বছর কলোরাডো স্টেইট ফেয়ার আর্ট কম্পিটিশনের প্রথম পুরস্কার জিতেছেন জেসন এলেন নামক একজন ভদ্রলোক। ‘ঞযবধঃৎব উ’ড়ঢ়বৎধ ঝঢ়ধঃরধষ’ নামক এই ছবিটি আঁকতে জেসন এলেনকে কোনো তুলি ব্রাশ ক্যানভাস হাতে নিতে হয়নি। ছবিটি তিনি এঁকেছেন মিডজার্নির চ্যাটবক্সে কয়েকটা শব্দ লিখে। বিষয়টি স্বভাবতই প্রচুর আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে : তবে কি টেক্সট লিখে অ্যাপগুলোকে ছবি আঁকার নির্দেশনা দিতে পারলেই যে কেউ শিল্পী হিসেবে গণ্য হবেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হবেন। ভবিষ্যতের শিল্পীদের হয়ত আর চারুকলা বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানে ছবি আঁকা শিখতে যেতে হবে না, যেতে হবে তুলি-কালি-ক্যানভাসহীন কম্পিউটার শেখার ক্লাসে!  

লন্ডন ॥ ১৪ এপ্রিল, ২০২৩

লেখক : কথাসাহিত্যিক

[email protected]

×