ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলে মাইলফলক অর্জন

অবকাঠামো খাত উন্নয়নে বিপ্লবের বছর 

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ০১:১৭, ১ জানুয়ারি ২০২৩

অবকাঠামো খাত উন্নয়নে বিপ্লবের বছর 

পরিবহন ও যোগাযোগ খাত উন্নয়নের বড় ধরনের একটি বিপ্লব হয়ে গেছে ২০২২ সালে

পরিবহন ও যোগাযোগ খাত উন্নয়নের বড় ধরনের একটি বিপ্লব হয়ে গেছে ২০২২ সালে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু চলতি বছরের ২৫ জুন খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি-নির্ভর বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়েছে এ বছর ২৮ ডিসেম্বর। এ ছাড়া সারাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের জন্য চলতি বছরে একসঙ্গে চালু হয় ১০০টি সেতু ও দুই হাজার কিলোমিটারের ১০০ সড়ক। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের অন্যান্য মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পসহ বেশিরভাগ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। 
এ ছাড়া ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)’র মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে গঠিত বাস রুট ন্যাশনালাইজেশন কমিটি। চলতি বছরে আরও দু’টি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন বাস সার্ভিস চালু করেছে এই কমিটি। এ নিয়ে তিনটি রুটে চলছে ঢাকা নগর পরিবহন বাস। তাই পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মেগা প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ও গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, এসটিপি’র এসব প্রকল্প অনেক আগেই বাস্তবায়নের দরকার ছিল। এগুলো বাস্তবায়ন হলে কিছুটা হলেও যানজট কমবে। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য শুধু অবকাঠামো তৈরি করলে হবে না। এর সঙ্গে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যেমন পদ্মা সেতু চালু করা হয়েছে। কিন্তু রিংরোড তৈরি করা হয়নি। এমনিভাবে মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হলে তেমনি ফুটপাত ব্যবস্থা হবে না। তাই টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি সমন্বিত সড়ক উন্নয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
পদ্মা সেতু : নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা রুটে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুটি নির্মাণ করা হয়। যা চলতি বছরের ২৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু চালুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলার মানুষের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। আগে যেখানে বরিশাল থেকে ঢাকা আসতে ৫-৮ ঘণ্টা সময় লাগত। পদ্মা সেতু চালুর ফলে এখন মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো যায় বলে বরিশালের যাত্রীরা জানান। 
মেট্রোরেল : ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬’র উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশটি ২৮ ডিসেম্বর চালু করা হয়। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল সার্ভিসের উদ্বোধন করেন। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর ৮৪ দশমিক ২২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে উড়াল ও পাতাল রেলের সমন্বয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেলের ৬টি লাইন। পুরো রেলপথ হবে ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৫৬৯ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে এবং ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের এই ছয়টি লাইনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

বঙ্গবন্ধু  টানেল : ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ মডেলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হচ্ছে সাড়ে তিন কিলোমিটারের সুড়ঙ্গপথ। চীনা অর্থায়নে চলমান বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা এবং পূর্ব প্রান্তে আনোয়ারা এলাকাকে যুক্ত করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলে দুটি টিউব রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী যান চলাচল করবে। এই টিউবটির অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। উত্তর পাশের টিউবটি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে। এই টিউবের সার্বিক নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। আর পুরো প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৯৪ শতাংশ বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : উত্তরার বিমান বন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক)। এ পর্যন্ত উড়াল সড়ক প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তিনটি অংশে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)’র মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) : গাজীপুরের শিববাড়ী থেকে উত্তরা বিমান বন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্রুতগতির পৃথক বাস লেন বা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি-৩) প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিবিআরটিসিএল)। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ২৫ শতাংশ। ৯ বছরে প্রকল্পের ব্যয় তিন দফা ও সময় চার দফা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা আরও ৬ মাস বাড়ানো হয়েছে বলে প্রকল্পের সূত্র জানায়।
পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্প : পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ বসানো হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লিংকের প্রায় ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ।’ প্রকল্পের পুরো কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ : ট্রান্স এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেলওয়ে রুটের অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করার  কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের আগ্রহের অভাবে দ্বিতীয় অংশের কাজ এখনো শুরু হয়নি বলে প্রকল্পের সূত্র জানায়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৭ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে রেলপথটি চালু হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

×