ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শুনানির অপেক্ষায় বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা ॥ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ॥ আইনমন্ত্রী

৪৩ লাখ মামলা নিষ্পত্তিতে বিচারক মাত্র দুই হাজার

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১০ মে ২০২৪

৪৩ লাখ মামলা নিষ্পত্তিতে  বিচারক মাত্র দুই হাজার

.

বিভিন্ন কারণে দেশের উচ্চ নিম্ন আদালতে প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বাড়ছে। বিচারক সংকট, সাক্ষীদের গরহাজির কিছু আইনজীবীর ভূমিকার কারণে প্রতিনিয়ত এই মামলা বাড়ছে। পাশাপাশি হত্যা মামলার ময়নাতদন্তের দেরির কারণেও মামলা ঝুলে যায়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়া মামলা হয় না। এটা দিতেও অনেক সময় দেরি হয়।  সারাদেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০৪টি মামলা। এদিকে সারাদেশের মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান উদ্যোগ নিয়েছেন। আদালতের মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য বিচারপতির সংখ্যা বাড়িয়ে বর্তমানে ১৩ জন বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে খবর জানা গেছে।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনজীবীরা বলছেন, মামলার জট আদিকাল থেকেই চলে আসছে। যে হারে মামলা হয় নিষ্পত্তিও হয়। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্যই বিচারপ্রার্থীরা মামলা করে থাকে। একইসঙ্গে  রয়েছে বিচারক সংকট, জায়গার অভাব, সাক্ষীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনা বিশেষ করে পুলিশ, ডাক্তার যারা সাক্ষী হন তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি হবার কারণেও মামলা শুনানিতে বিঘœ ঘটে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, দেশের মাত্র দুই হাজার বিচারক ৪০ লাখের অধিক মামলা নিষ্পত্তির কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তবুও মামলা জট হতে আমরা পরিত্রাণ পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হতে দশ-বারো বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে হয়তো বিচারপ্রার্থী লোকটি সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে। এসব আমাদের দেশের বাস্তবতা।

আইনের মাধ্যমে সুবিচার পেতে জনগণের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল নাগরিকের জন্য বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আগের তুলনায় মামলা জট কমতে শুরু করেছে। আমাদেরকে নজর দিতে হবে নতুন যে মামলা হচ্ছে তার চেয়ে যাতে বেশি করে নিষ্পত্তি হয়। সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যাবে।

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি ছিলেন ১০০ জন, এখন সেটা কমে এসেছে। অবসরে গেছেন অনেকে, আপিল বিভাগে গেছেন অনেকে। এখন নেমে এসেছে ৮৪ জনে। রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে শীঘ্রই হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। বিচারপতি নিয়োগের জন্য আইন যেটা করার সেটাও কিন্তু আমরা শেষ করে এনেছি। হাইকোর্টেও বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে যে আইন প্রয়োজন তা নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করতে শীঘ্রই একটা সময় তারিখ দেওয়া হবে।

সূত্র মতে, প্রতিদিন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা- মোকদ্দমা হচ্ছে। তা ছাড়া জনগণের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে বিশেষ করে ফৌজদারী মোকদ্দমার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় বিচারকসহ অন্যান্য সুযোগ-সবিধা খুবই অপ্রতুল। ফলে অনেক সময় ফৌজদারী মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। ছাড়া তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। শতাধিক বছরের পুরনো বৃটিশ আমলের প্রণীত আইন দ্বারা ফৌজদারী বিচার সম্পন্ন হয়। কিন্তু যুগের বিবর্তন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের ধরন প্রকৃতি পরিবর্তিত হওয়ায় শতাধিক বছরের পুরনো আইন দ্বারা বিচার নিষ্পত্তি করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যার ফলে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি  হচ্ছে। বিশেষ করে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তথা সামান্য কারণে মামলা দায়েরের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আদালতসমূহ এসব মামলার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে।

মামলার জট থাকলেও বর্তমানে আপিল হাইকোর্ট বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল, পার্বত্য শান্তি চুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ অসাংবিধানিক ঘোষণা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। হাইকোর্ট বিভাগের রয়েছে, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা, রিফাত শরীফ হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা, মো. রাশেদ খান হত্যা রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা ডেথ রেফারেন্স আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপেক্ষায় থাকা নিহতের আত্মীয়স্বজনরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিচার নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অ্যাটর্নি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সমস্ত মামলা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সহসাই গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হবে। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এত বিপুলসংখ্যক চাঞ্চল্যকর মামলা আটকে থাকাটা উদ্বেগজনক। বিচারক বেঞ্চ বাড়িয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সারাদেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০৪টি মামলা। সুপ্রিম কোর্টে লাখ ৭০ হাজার। যাতে আপিল বিভাগে ২৬ হাজার ৫১৭ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭। আপিল বিভাগে থাকা মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৬ হাজার ৬৭, ফৌজদারি ১০ হাজার ২৭০ এবং আদালত অবমাননা সংক্রান্ত ১৮০টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি ৯৫ হাজার ৫৩, ফৌজদারি লাখ ২২ হাজার ৫৬৪ এবং রিট লাখ হাজার। নি¤œ আদালতে বিচারাধীন ৩৭ লাখ হাজার মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৪ এবং ফৌজদারি মামলা ২১ লাখ ১০ হাজার ৬৯৬। অধস্তন আদালতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন দেওয়ানি ফৌজদারি মামলার সংখ্যা লাখ ১২ হাজার ২৫৪। এর মধ্যে দেওয়ানি লাখ ১১ হাজার ৬২৫ এবং ফৌজদারি মামলা লাখ ৬২৯টি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে  বলেছেন, পদ্ধতিগত কারণে মামলার দীর্ঘ জট তৈরি হচ্ছে। সনাতনী পদ্ধতিগত কারণে মামলা জট বেড়ে যাচ্ছে। কারণে অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষদের মতে, নোটিস জারি হয় বছরের পর বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হবার কারণে পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিস জারি হয়ে ফেরত আসায় পরে ভুল নথিতে বিষয়গুলো উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হতেই দীর্ঘ বিলম্ব হয়। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সেকশনে চলে যায়। নতুন করে তালিকা অন্তর্ভুক্ত করতে শুনানিঅন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। বিষয়গুলো ভাবা দরকার।

×