.
হজ একটি ফরজ ইবাদত। নামাজ, রোজা, যাকাত যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য হজ একটি অন্যতম বরকতপূর্ণ অবধারিত কর্তব্য। হজ মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও ইজ্জতের আসন দান করে, সৌভাগ্যের দরজা খুলে দেয় প্রকৃত হাজির জীবনে। পবিত্র বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত শরীফের একটি হাদিসে আছে, আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে পুরনুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, যখন তুমি হাজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন তুমি তাকে সালাম করবে, মুসাফাহা করবে এবং তার বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে তাকে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধ করবে। কেননা তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত।
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস হতে একজন হাজি সাহেবের বড় ধরনের সামাজিক মর্যাদার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃত হাজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ওয়াজ-নসিহত, লেনদেন, কথাবার্তা মানুষ ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করে। অবশ্য কোনো কোনো হাজি সাহেব মানবীয় দুর্বলতা হতে মুক্ত হতে না পেরে হাজি সাহেবানদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার মতো কর্মকা-ও করে বসেন। এ ধরনের হীনম্মন্যতা হতে হাজিদের পবিত্র থাকতে হবে।
একইভাবে সত্যিকারের হাজিদের জন্য আখিরাতে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কারের সুসংবাদ। নবীজি (স.) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি কামাচার ও অন্যায় কার্যাদি হতে বিরত থেকে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার রিজামন্দির উদ্দেশ্যে হজ আদায় করে সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে। (বুখারী, মুসলিম)। হযরত রাসূলে মাকবুল (স.) আরও বলেছেন, ‘জান্নাতই হচ্ছে একমাত্র মাকবুল (বা গ্রহণযোগ্য) হজের পুরস্কার।’ (মিশকাত)।
মুমিন মুসলমান মাত্রেই পবিত্র হজ ও উমরা পালনের মাধ্যমে পবিত্র খানায়ে কাবার জিয়ারত, পুণ্যভূমি আরবের বিভিন্ন বরকতময় স্থান পরিদর্শন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পবিত্র মাজার শরীফ জড়িয়ে ধরে সালাম প্রদর্শনের জন্য পুতঃতামান্না পোষণ করেন। গরিব মুসলমানগণ আজীবন সে স্বপ্ন নিয়ে নামাজে-কালামে পরওয়ারদিগারের কাছে মোনাজাত করেন।
অনেক সামর্থ্যবান হাজি একবার ফরজ হজ সম্পাদন করা সত্ত্বেও পুনঃপুন হজ ও উমরা করেন আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনে ও নবীপাক (স.) এর মুহাব্বতে। আসলে মুমিনদের মনমানসিকতা এমন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এর ব্যতিক্রম স্বভাবের মানুষও নিতান্ত কম নয়; যাদের আল্লাহ অশেষ অনুগ্রহ করেছেন, দিয়েছেন ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য। এসবের পয়লা নম্বর দাবি হলো আল্লাহপাকের ঘরের জিয়ারত। কিন্তু দেখা যায়, এ ধন-সম্পত্তিই যেন তার জন্য কাল হয়েছে। তার চাহিদা এবং ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে যে, হজে যাওয়ার তার সময়-ই হয়ে ওঠে না।
আমার জানামতে, এমন অনেক দুর্ভাগা ধনী রয়েছেন, যাদেরকে আল্লাহতায়ালা কোটি কোটি টাকা দেওয়া সত্ত্বেও জীবনে হজ নসিব হয়নি; কেউ কেউ যথেষ্ট বয়স পাওয়া ও দুনিয়াদারি করার সুযোগ ভোগ করা সত্ত্বেও হজের সুযোগ গ্রহণ না করে দুনিয়া হতে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে এ এক দুর্ভাগ্যের সংবাদ। নবীজি হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদিস শরীফে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন- ‘ মাম মালাকা যাদান ওয়া রাহিলাহ তুবাললিগহু ইলা বায়তিললাহ, ওয়ালাম ইয়াহুজ্জা ফালা আলাইহি আঁই ইয়ামুতা ইয়াহুদিয়া.... ।’ অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর গৃহ (কাবা ঘর) পর্যন্ত পৌঁছার উপযুক্ত ধন-সম্পদ ও সাওয়ারীর মালিক হওয়া সত্ত্বেও হজ আদায় করলো না সে ইয়াহুদি হয়ে মরুক আর নাসারা হয়ে মরুক, তাতে আল্লাহর কিছু আসেযায় না।’-(তিরমিযি)।
ইসলামি শরিয়তে হজ ফরজ হওয়ার জন্য ৭টি পূর্বশর্ত রয়েছে যেমন- (১) মুসলমান হওয়া (২) জ্ঞানবান হওয়া (৩) বালিগ হওয়া (৪) আজাদ বা স্বাধীন হওয়া (৫) আর্থিক দিক থেকে হজ পালনে সক্ষম হওয়া (৬) হজ ফরজ হওয়ার ইলম থাকা (৭) হজের সময় হওয়া।-(শামী-২)। একইভাবে হজ আদায় ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলি ৫টি (১) শারীরিক সুস্থতা (২) রাস্তাঘাট নিরাপদ হওয়া (৩) কারাবন্দি না হওয়া (৪) মহিলার ক্ষেত্রে স্বামী কিংবা অন্য কোনো (বিবাহ নিষিদ্ধ পুরুষ) ‘মাহরাম’ সঙ্গে থাকা এবং (৫) মহিলাদের ইদ্দত পালনের অবস্থা হতে মুক্ত হওয়া। (প্রাগুক্ত)।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলদেশ থেকে প্রকাশিত ফাতাওয়া ও মাসাইল এর ৪র্থ খন্ডের ১৪৭ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির উপর হজ ফরজ হয়েছিল কিন্তু বিনা ওজরে সে হজ আদায় করেনি। পরে গরিব এবং নিঃস্ব হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তার জিম্মায় হজ বাকি থেকে যাবে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হজ আদায় করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার উপর অপরিহার্য হবে।
উল্লেখ্য, জীবনে হজ একবারই ফরজ হয়। যে বছর হজ ফরজ হয় ওই বছরেই তা আদায় করা ফরজ। শরিয়ত স্বীকৃত কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ওই বছরই আদায় করতে হবে। অকারণে বিলম্ব করা জায়েজ নয়। যদি পিতা-মাতা ব্যতীত ছোট শিশুকে দেখার মতো কেউ না থাকে, তাহলে পিতা-মাতা এই কারণে হজ আদায়ে বিলম্ব করতে পারেন। শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকুক বা খারাপ থাকুক উভয় অবস্থাতে এই হুকুম প্রযোজ্য হবে। যদি কারও জিম্মায় হজ ফরজ অথচ তার পিতা-মাতা অসুস্থতা অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে তার খিদমতের মুখাপেক্ষি হয়ে পড়ে, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি ছাড়া সন্তানের হজে গমন করা মাকরূহ। আর যদি খিদমতের প্রয়োজন না থাকে, তাদের অনুমতি ছাড়া হজে গমন করতে কোনো দোষ নেই।
পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদির ক্ষেত্রেও এ হুকুম প্রযোজ্য হবে। সুবাহানাল্লাহ। ইসলামি শরিয়ত ময়মুরুব্বিদের সেবা-যত্নে কত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। শুধু পিতা-মাতা, দাদা-দাদির সুখ-শান্তির কথা বিবেচনা করে বহু ইবাদত-বন্দেগি ইসলামি শরিয়তে সংক্ষিপ্ত করার বিধান রয়েছে। শরিয়ত নফল হজ আদায়ের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার অনুমতি ছাড়া সর্বাবস্থায় মাকরূহ সাব্যস্ত করেছে। রাস্তা নিরাপদ হোক বা না হোক এবং তাদের খিদমতের প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় এ হুকুম প্রযোজ্য হবে।
উল্লেখ্য, যদি কারও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং যাদের খোরপোষ তার দায়িত্বে রয়েছে, তারা যদি হজে যাওয়ার ব্যাপারে নারাজ থাকে এবং তাদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা না থাকে, তবে হজে যাওয়াতে কোনো দোষ নেই। আর যাদের খোরপোষ তার দায়িত্ব নয়; এরূপ লোকেরা হজে যাওয়ার ব্যাপারে নারাজ থাকলে এবং হজে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকলে এ অবস্থায়ও হজে যাওয়াতে কোনো দোষ নেই।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির নিকট যদি এ পরিমাণ মাল থাকে যার দ্বারা সে ঋণ পরিশোধ করতে সামর্থ্য-এরূপ ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধ না করে হজে যেতে চায়, তবে হজে যাওয়া তার জন্য মাকরূহ। কিন্তু ঋণদাতারা অনুমতি দিলে হজে যাওয়া জায়েজ হবে। কেউ যদি কর্জের জামিন হয় এবং ঋণদাতা ব্যক্তির অনুমতিসাপেক্ষ হয় তবে কর্জদাতা এবং জামিনদার ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া সে হজে যেতে পারবে না। আর যদি ঋণদাতা ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কেউ জামিনদার হয় তবে কর্জদাতা, ঋণদাতার অনুমতি ছাড়া ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি হজে যেতে পারবে না। কিন্তু জামিনদারের অনুমতি অপরিহার্য নয়।-(আলমগীরী-১)।
হজে যাওয়ার সময় উপরোক্ত মাসলা-মাসায়িলগুলো আমাদের গোচরীভূত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহপাক আমাদের জীবনে হজে মাকবুল নসিব করুন।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব