ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ডায়াবেটিস রোগের আশীর্বাদ  ইন্সুলিনের শতবর্র্ষ

দলেওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ৯ মে ২০২৪; আপডেট: ২০:৫৩, ৯ মে ২০২৪

ডায়াবেটিস রোগের আশীর্বাদ  ইন্সুলিনের শতবর্র্ষ

.

পানির অপর নাম জীবন। এ কথা যেমন সত্য, তেমনি ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ইন্সুলিন জীবন রক্ষায় একটি অপরিহার্য মহৌষধ। এটি আবিষ্কার হয়েছিল আজ থেকে শত বছর আগে ১৯২১ সালে। গোটা বিশ্বে অন্যান্য রোগবালাই মানুষকে যেভাবে গ্রাস করেছে, তার মধ্যে নীরব মরণব্যাধি ডায়াবেটিসের সংক্রমণ বা আক্রমণ বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে বলা হচ্ছে, বিশ্বে আজ প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। ঘাতক ব্যাধি ডায়াবেটিস এখন এক মহামারির অপর নাম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই রোগাক্রান্তের হিসাবটা দাঁড়ায়- ২০২১ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৩৭ মিলিয়ন। এই হিসাবে প্রতি দশজনের মধ্যে একজন আক্রান্ত। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪৩ মিলিয়ন। ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৭৮৩ মিলিয়ন। ডায়াগনোসিস ছাড়া আছেন ২৪০ মিলিয়ন, যার অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ পর্যায়ের ঝুঁকিতে রয়েছেন ৫৪১ মিলিয়ন রোগী।

অপরদিকে বলা হয়েছে,  নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শিশু এবং কিশোর রোগীর সংখ্যা ১.২ মিলিয়ন। ২০২১ সালে এই রোগে মারা গেছে ৬.৭ মিলিয়ন রোগী। এ বছর এই রোগের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতি ৬ জন শিশুর ১ জন জন্মের সময় এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ নিয়ে। তাদের সংখ্যা ২১ মিলিয়ন। এই পরিসংখ্যান থেকে আঁচ করা যায় যে, কতটা ভয়াবহ অবস্থায় দ্রুত ঘটছে এর প্রাদুর্ভাব মহামারিরূপে।

সেই মহামারিকে মোকাবিলা করে আসছে মানব কল্যাণে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার- ইন্সুলিন। এই মহৌষধটি ১৯২১ সালে আবিষ্কার করেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ফ্রেডারিক জি বেন্টিং, চার্লস এইচ বেস্ট এবং জে আর ম্যাকলেওড। পরে এর পরিশীলন ঘটে জেমস বি কলিপের হাতে। মানব ইতিহাসের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার বিশ্বের লাখো কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় এক মাইলফলক হিসাবে আবির্ভূত হয়। তারপর থেকে আজ অবধি ডায়াবেটিস রোগের ওপর নিরলস গবেষণা ও চিকিৎসায় প্রতিনিয়ত আশীর্বাদ হয়ে আসছে পরিবর্তিত ও পরিশীলিত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, পদ্ধতি এবং নতুন ওষুধপত্র।

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ১৯২০

সে বছর গবেষণারত সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা দেখতে পান- মানবদেহে প্যানক্রিয়াসে বিদ্যমান আইসলেট নামের যে কোষগুচ্ছ থেকে শরীরে প্রয়োজনীয় ইন্সুলিন উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সচল থাকে, তা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে অচল হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থাটিকে সচল করে ইন্সুলিন উৎপাদনে সক্ষম করার কাজে আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফলকাম হতে পারেননি গবেষকরা। প্রথমে সার্জন বেন্টিং এককভাবে উদ্যোগ নিয়ে সফলকাম হতে না পেরে ১৯২০ সালের ৭ নভেম্বর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গবেষক জন ম্যাকলেওডকে সঙ্গে নিয়ে আবারও গবেষণায় ব্যাপৃত হন। সেখানে গবেষণাগারে যোগ দেন গবেষক শিক্ষার্থী চার্লস বেস্ট।

১৭ মে, ১৯২১ সালে বেন্টিং, বেস্ট এবং ম্যাকলেওড- তিনজন সম্মিলিতভাবে গবেষণার কাজ শুরু করেন। তারা একটি কুকুরের দেহ থেকে প্যানক্রিয়াস (অগ্নাশয়) অপসারণের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করেন ইন্সুলিন উৎপাদনের উৎস সরিয়ে নেওয়ার ফলে ব্লাড সুগারের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত এবং অত্যধিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে ইন্সুলিন উৎপাদনে অক্ষম প্যানক্রিয়াস থেকে সংগৃহিত ইন্সুলিন নির্যাসের কার্যকারিতা কতটুকু, তার সুফল পান একটি কুকুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে। ১৯২১ সালের ১০ নভেম্বর তারা সফলতার মুখ দেখেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একটি কুকুরের দেহে ৭০ দিন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার পর সাফল্য আসে হাতের মুঠোয়।

ইন্সুলিনকে মানবদেহে ব্যবহারের জন্য আরও পরিশুদ্ধ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯২১ সালের ১২ ডিসেম্বর গবেষকদের দলে যোগ দেন বায়োকেমিস্ট জেমস কলিপ। তখন গবাদিপশুর প্যানক্রিয়াস থেকে উৎপাদিত ইন্সুলিন নিয়েই এই পরিশীলনের কাজ করা হয়।

মানবদেহে প্রথম ইন্সুলিন

রক্তে উচ্চমাত্রার সুগারের কারণে সংকটাপন্ন জীবনের মুখোমুখি ১৪ বছর বয়সী লিওনার্ড থম্পসনের দেহে ১৯২২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম ইন্সুলিন প্রয়োগ করা হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লিওনার্ডের শরীরে ব্লাড সুগারের পরিমাণ বিস্ময়কভাবে নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও ইঞ্জেকশনে ইন্সুলিন পুশ করার স্থানে ফোঁড়া এবং কীটনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কলিপের নিরলস গবেষণা অব্যাহত থাকে।

 ১৯২২ সালের ২৩ জানুয়ারি লিওনার্ডকে দ্বিতীয়বার আরও পরিশুদ্ধ ইন্সুলিন দেওয়া হয় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে। এবারের প্রচেষ্টা শতভাগ সফল প্রমাণিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে যুক্ত হয় এক অসাধারণ অধ্যায়। রোগীর ব্লাড সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের কাছাকাছি দাঁড়ায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত থাকে। এই আবিষ্কারের ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস সম্পূর্ণরূপে মৃত্যুর ঝুঁকি মুক্ত প্রমাণিত হয়।

বিশ্বব্যাপী সুখবর

১৯২২ সালের ৩ মে, ম্যাকলেওড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান ফিজিশিয়ান্সের এক সমাবেশে বিশ্ববাসীর কাছে এই যুগান্তকারী সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। সমাবেশে সকলে দাঁড়িয়ে আবিষ্কারকদের প্রাণঢালা সম্মাননা জানান। এই সমাবেশেই গবেষক দল ওষুধটির নাম প্রথম উচ্চারণ করেন- ইন্সুলিন। তিন বিজ্ঞানী বেন্টিং, কলিপ এবং বেস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আবিষ্কারের মালিকানা বা প্যাটেন্ট স্বত্ব লাভ করেন ১৯২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। তারা এই স্বত্ব বিক্রি করে দেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নাম মাত্র ১ ডলার মূল্যে। বেন্টিং এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি বা আমরা কেউই ইন্সুলিনের মালিক নই। এর মালিকানা গোটা বিশ্ববাসীর। আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের ওষুধটি পাওয়ার অধিকার আছে।

ইন্সুলিন আবিষ্কারের এই খবর রাতারাতি গোটা বিশ্বের মানুষকে একটি নতুন জীবন লাভের আশায় উদ্বেল করে তোলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা দেয় দিগন্ত উন্মোচনকারী এক নতুন যুগের। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের রোগী ও চিকিৎসক ওষুধটি হাতে পাওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় মরিয়া হয়ে দিন গুনতে থাকেন। তাই গবেষক ও আবিষ্কারক দল বিশ্ববাসীর চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ব্যাপক হারে উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের পদ্ধতি ও ব্যাপক উন্নয়ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।

বিশ্ববাসীর জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি আসে ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। ইন্সুলিন বাণিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের দায়িত্ব পায় বিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি এলি লিলি  (Eli Lilly)। জাহাজযোগে এর প্রথম শিপমেন্ট হয় ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। এর দুদিন পর ২৫ অক্টোবর যুগান্তকারী এই ওষুধ আবিষ্কারের জন্য যৌথভাবে বেন্টিং এবং ম্যাকলেওডকে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। বেন্টিং নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থের অংক থেকে অর্ধেক বা ৫০ ভাগ স্বেচ্ছায় সহকর্মী বেস্টকে দান করেন। একই পথ অনুসরণ করে ম্যাকলেওড তার প্রাপ্ত অর্থের ৫০ ভাগ দান করেন অপর সহকর্মী কলিপকে।

ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন

১৯৩৪ সালে যুক্তরাজ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সকল রোগীর চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ এবং অধিকারের লক্ষ্য নিয়ে ঔপন্যাসিক এইচজি ওয়েলস এবং ডাক্তার আর ডি লরেন্স প্রথম ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তারা দুজনেই ছিলেন টাইপ- ১ ডায়াবেটিসের রোগী। এরপর কলমের আদলে ইন্সুলিন পেন এবং পাম্প তৈরি করা হয়। একইসঙ্গে এই রোগে ঝুঁকির সহজ শিকার অঙ্গ- চোখের দৃষ্টিশক্তির বিপর্যয় রোধ এবং সংক্রমণের হাত থেকে পা বাঁচানোর জন্য- এই দুইয়ের নিয়মিত পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয় সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক এবং হাসপাতালগুলোতে। ফলে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের অঙ্গহানির ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখার সকল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায়। শুধু তাই নয়, টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে কীভাবে চিরতরে জব্দ করা যায়, সেই গবেষণাও চলছে নিরন্তর। গবেষণা চলছে অগ্নাশয় প্রতিস্থাপনের এবং ইন্সুলিন মুক্ত জীবন লাভের।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক

[email protected]

×