ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

 অর্থনীতিতে তাপপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৯ মে ২০২৪

 অর্থনীতিতে তাপপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব

.

যুদ্ধ, মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের সামনে অনেক দিন ধরেই বড় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত গত এক দশকে বিশ্ববাসীর সামনে জলবায়ুর পরিবর্তন মূর্তিমান এক আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। একদিকে পানির জন্য হাহাকার করা মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে বৃষ্টি আর সবুজের চিত্র ফুটে উঠছে, বন্যা সবকিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে শীতে সারা বছর জবুথবু হয়ে থাকা মানুষ প্রাণিমন্ড বছরের বিশেষ কোনো সময়ে গরমে হাঁসফাঁস করছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির নানা নেতিবাচক প্রভাব আমাদের চিরাচরিত শস্য-শ্যামলা সবুজ বাংলাদেশকেও ক্রমশই কাবু করে ফেলছে। দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির আমাদের দেশকে নতুন নতুন সমস্যা-সংকটের মুখোমুখি করছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় গরমের তীব্রতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জনজীবন এখন অতিষ্ঠ। আক্ষরিক অর্থেই তীব্র উষ্ণায়নের প্রভাব মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে যাদের অর্থ-বিত্ত আছে তারা নিজেদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় আবদ্ধ রেখে সেখানে বসেই অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আর যাদের সেই সুযোগ নেই অর্থাৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, তারা চেষ্টা করছেন সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যক্তি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। সব মিলিয়ে অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন নিয়ে এসেছে। যার প্রভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প সেবা খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রার প্রভাবে মানুষের উৎপাদন শক্তি হ্রাসের কারণে রাজধানী ঢাকায় বার্ষিক বিলিয়ন ডলার বা ,৫৭,০৯,৩৬,০০,০০০.০০ বাংলাদেশী টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাদের মতে, অর্থনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ সূচকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের বার্ষিক যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার আর্থিক মূল্যমান শত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই ক্ষতি বন্ধে নীতিনির্ধারকেরা জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্য বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।

করোনার অভিঘাত, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ অর্থনৈতির মন্দার সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিস্থিতির সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে পুরো জাতীয় অর্থনীতিতে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) অনেক দিন ধরেই বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরির্বতনের নেতিবচাক প্রভাব নিয়ে সতর্ক করে আসছে। তবে চলতি বছর সংস্থাটি এক কথায় চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে খুব দ্রুত বিশ্বকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। তবে এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলবর্তী নিচু অঞ্চলের দেশগুলো। ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। গত মাসে (এপ্রিলে) একটানা ১৫-২০ দিনের মতো তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। সময় ৫৮ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে চুয়াডাঙ্গায় ৪২. ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপপ্রবাহ ছাড়াও প্রাকৃতিক কারণে দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।

গরমের তীব্রতা বৃদ্ধিতে মানুষের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নানা রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। অনেক মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যায়। পাশাপাশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি দেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবকাঠামো ধসে পড়ে। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিদ্যুতের ওপর চাপ পড়ে। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খরার সম্ভাবনা বাড়ে। তখন সমস্যা দ্বিগুণ হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে প্রতি ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে একটি দেশের জিডিপি দশমিক ২৫ শতাংশ কমে যায়। তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অল্পতেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। অত্যধিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কর্মীদের কাজ করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে শত শত বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। জলবায়ু নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক অ্যাড্রিন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিষয়টি উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর আনুমানিক ১০ হাজার কোটি ডলার হারাচ্ছে। তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এটি সে দেশের জিডিপির প্রায় দশমিক শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ৫০ হাজার কোটি ডলার, যা দেশটির জিডিপির শতাংশ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে ঢাকা শহরের কর্মজীবী গোষ্ঠীর কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

এতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বার্ষিক ৬০০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ ঢাকা শহরের মোট উৎপাদন ক্ষমতার শতাংশের বেশি। যদি তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে পরিমাণ বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৭০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। মাথাপিছু হিসেবে কর্মঘণ্টা কমার পরিমাণ ২৫৪ ঘণ্টা। জার্মানওয়াচ-এর ২০২১ সালের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সূত্রে জানানো হয়, জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রতিষ্ঠানটির মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ২০০০-২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩৭২ কোটি ডলার। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে কর্মীদের কাজ করার ক্ষমতা ১৬ শতাংশ কমে যায়। ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে কর্মক্ষমতা কমে ২৯ শতাংশ আর তাপমাত্রা যদি ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে সেক্ষেত্রে কর্মক্ষমতা ৪৭ শতাংশ কমে যায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি এখানে শিল্পায়ন হয়নি। শিল্প বিপ্লবের কোনো কিছু না মেনে যা হয়েছে তা হলো অনানুষ্ঠানিক খাতের বিস্তৃতি অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট দুর্দশা-বঞ্চনা-বৈষম্য-বিচ্ছিন্নতা। আমাদের দেশে এখন মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী, সংখ্যার হিসেবে মোট কোটি ৮২ লখ হাজার। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র-বঞ্চিত-দুর্দশাগ্রস্ত-স্বল্প মজুরির বিপন্ন মানুষ। তাদের জন্য কোনো নি¤œতম মজুরি আইন নেই বললেই চলে। অথবা যতটুকু আছে ততটুকুও বাস্তবে নেই। এসব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা বলতে কিছু নেই। সন্তানদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা-নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিগত ৩০ বছরে আমাদের মোট জনসংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ, অথচ দরিদ্র-বিত্তহীন জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের উৎপাদন শক্তি ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। বিকাশমান অর্থনীতির বাংলাদেশের জন্য যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই অবস্থায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব নিরসনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আপামর জনগণকেও বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেসবুজ অর্থনীতি ধারণা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। আমাদের বাড়িঘর কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে তৈরি করতে হবে। লক্ষ্যে সরকারকে সবুজ কর প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যষ্টিক সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রেই পরিবেশ দূষণকারী কর্মকা প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। তা না হলে তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। ফলে আমাদের শারীরিক মানসিক ক্ষতি তো হবেই, অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে অপরিসীম।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×