
শেখ রাসেল
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন আজ। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে তার জন্ম। তার মূল নাম শেখ রিসাল উদ্দিন। ডাকনাম রাসেল। তার ছোট বোন শেখ রেহানা তাকে আদর করে রাসুমণি বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। বেগম মুজিব বার্ট্রান্ড রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এমনই ভক্ত হয়ে যান যে, তারা তাদের ছোট সন্তানের নাম বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে নামটি রাখেন। শেখ রাসেলের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে চট্টগ্রামে ছিলেন।
টেলিফোনে রাসেলের জন্মের খবর পান তিনি। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। তাই পরিবারের সব আনন্দ রাসেলকে ঘিরেই ছিল। বড় ভাইবোনদের আদর সোহাগে রাসেল বড় হতে থাকে। জন্মের প্রথমদিন থেকে রাসেলের ছবি তোলা শুরু হয়। সব ভাইবোন মিলে ওর জন্য আলাদা একটা অ্যালবাম করেছিলেন। জন্মের দিন থেকে প্রতিমাস, প্রতি তিন মাস, ছয় মাস অন্তর শেখ রাসেলের ছবি অ্যালবামে সাজানো হতো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে অন্যসব জিনিসপত্রের সঙ্গে অ্যালবামটাও লুট করে নিয়ে যায়। রাসেল তার বড় বোনকে ‘হাসুপা’ বলে ডাকত।
বড় দুই ভাই কামাল ও জামালকে ‘ভাই’ বলত আর ছোট বোন রেহানাকে ‘আপু’ বলত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধু তখন ৬ দফা দিলেন। তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল তার পিতাকে খুঁজত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেখ রাসেলের প্রতি ছিল অপরিসীম পিতৃস্নেহ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক গ্রন্থের অনেক জায়গায় তাঁর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলের কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থের ২৪৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বালি চলো। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও।
আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ কারাগারের রোজনামচা’র ২৩৪ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে।
আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্টু হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে। আমি ওকে বললাম, তুমি রেহানাকে মার? রাসেল বলল, হ্যাঁ মারি। বললাম, না আব্বা আর মেরো না। উত্তর দিল, মারবো। কথা একটাও মুখে রাখে না।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বন্দি বেগম মুজিবসহ পরিবারের সবাই ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর তারার সহযোগিতায় মুক্ত হন ১৭ ডিসেম্বর। সেদিন শেখ রাসেলই পতাকা হাতে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়। ছোট্ট রাসেলের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। সে ক্ষণিকের জন্যও তার আব্বাকে হাতছাড়া করতে চাইত না। সব সময় রাসেল তার আব্বার পাশে পাশে ঘুরে বেড়াত। রাসেল প্রতিদিন বিকেলে গণভবনে যেত, তার প্রিয় সাইকেলটাও সঙ্গে নিত। সাইকেল চালানো তার খুব প্রিয় ছিল। রাসেলের মাছ ধরা খুব পছন্দ ছিল। রাসেল মাছ ধরার পর আবার ছেড়ে দিত।
রাসেল তার পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। সে তার আব্বাকে কখনো ছাড়তে চাইত না। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ওকে নিয়ে যেতেন। বেগম মুজিব ছোট ছেলে শেখ রাসেলের জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন, রাসেলও সেদিন পরত। দেশ স্বাধীনের পর আমাদের মুক্তিযুুদ্ধ সমর্থনকারী জাপান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল ও শেখ রেহানাকে জাপান নিয়ে যান। রাসেলের জন্য বিশেষ কর্মসূচিও রাখে তৎকালীন জাপান সরকার।
শেখ রাসেল একটি আবেগপ্রবণ সত্তা, শিশু অধিকার রক্ষার মূর্ত প্রতীক। ১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। রাসেল মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিন বেঁচে ছিল। আজ শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৫৯ বছর। শেখ রাসেলের বাঁচার অধিকার হত্যাকারীরা অভয় দিয়েও রক্ষা করেনি। শেখ রাসেল বিশ্বের অধিকারহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত শিশুদের প্রতীক ও প্রতিনিধি।
আজ রাসেল বেঁচে থাকলে হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি, বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতকে করতে পারতেন আরো শক্তিশালী। পরিশেষে বলব, শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। শেখ রাসেল তোমার মৃত্যু নাই, তুমি বেঁচে আছ কোটি শিশুর অন্তরে। শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল।
লেখক : সংস্কৃতি কর্মী